আসামের লোকনৃত্য
আসামের লোকনৃত্যের মধ্যে রয়েছে বিহু ও বাগুরুম্বা (উভয় নৃত্যই বসন্ত উৎসবের সময় অনুষ্ঠিত হয়), ভোরতাল, ওজাপালি নৃত্য। আসাম বহু জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল: মুসলিম, ইন্দো-আর্য, রাভা, বোডো, ডিমাসা, কার্বি, মিসিং, সোনোয়াল কাছাড়ি, মিশমি ও তিওয়া (লালুং) ইত্যাদি। এই সকল সংস্কৃতিসমূহ একত্রিত হয়ে অসমীয়া সংস্কৃতি গঠন করেছে। আসাম রাজ্যের বাসিন্দাদের "অসমীয়া" (অখমিয়া) নামে অভিহিত করা হয়। অধিকাংশ উপজাতির নিজস্ব ভাষা রয়েছে, যদিও অসমীয়া ভাষা রাজ্যের মুখ্য ভাষা[৪][৫] আসামে অনেক মেলা ও উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় সমস্ত উপজাতীয় উৎসব বসন্তকালে অনুষ্ঠিত হয় এবং চাষাবাদ অথবা ফসল কাটা উদযাপন করে। আসামের উৎসবসমূহের মধ্যে বিহু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য; এটি অসমীয়া সমাজের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে একত্রিত করে। বিহুঅসমীয়া জাতির সঙ্গে ওতঃপ্রোতঃ ভাবে জড়িত হয়ে থাকা এই নৃত্যেরসূত্রের বিষয়ে সঠিক প্রমাণ পাওয়া না গেলেও বিহু নৃত্য চুটিয়া, মরান, দেওরি, সোনোয়াল, থেঙ্গাল প্রভৃতি জনজাতির মধ্যে প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়, যারা আহোমদের আগে থেকে আসামে বসবাস করছিল। প্রায় ১৬শ (খ্রীষ্ঠাব্দ) শতকে আহোম স্বর্গদেউ রূদ্রসিংহ-এর সময় থেকে এই নৃত্যের প্রচলন আছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। প্রায় ১৬৯৪ সাল থেকে স্বর্গদেউ রূদ্রসিংহর পৃষ্ঠপোষকতায় রঙালী বিহু উপলক্ষে রংঘর-এর মজিয়াতে এই নৃত্য প্রদর্শন করা হত। বিবরণবিহু হল একটি দলগত নৃত্য, এতে পুরুষ ও মহিলা একসঙ্গে, পৃথক লিঙ্গ ভূমিকা বজায় রেখে নৃত্য প্রদর্শন করে। সাধারণত, মহিলারা সারিবদ্ধভাবে বা বৃত্তাকারে নৃত্য করেন। পুরুষ নর্তক ও সঙ্গীতশিল্পীরা প্রথমে নৃত্যের স্থানে প্রবেশ করে, তাদের সারি বজায় রাখে এবং নির্দিষ্ট তাল অনুসরণ করে। পরে মহিলা নর্তকীরা প্রবেশ করলে, পুরুষ নর্তকেরা মহিলা নর্তকীদের সাথে মিশে যাওয়ার জন্য তাদের সারি ভেঙে দেয় (তবে তাদের নির্দিষ্ট গঠন ও নাচের ক্রম বজায় রাখে)। এটি সাধারণত নির্দিষ্ট অঙ্গবিন্যাস দ্বারা চিহ্নিত করা হয়: নিতম্ব, বাহু এবং কব্জির নড়াচড়া; ঘুরপাক, উবু হওয়া ও ন্যুব্জ হওয়া। শুধুমাত্র কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য বাদে, পুরুষ ও মহিলাদের নৃত্যের গতিবিধি অনেকটাই একই রকম। পরিবেশনচিরাচরিত বিহু সঙ্গীতে নৃত্য পরিবেশিত হয়। ঢাকীরা হলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গীতশিল্পী, যারা একটি লাঠি ও হাতের তালু দিয়ে দুমুখো ঢাক বাজান। একটি পরিবেশনে সাধারণত একাধিক ধুলিয়া থাকে; প্রতিটি পরিবেশনে বিভিন্ন বিভাগে বিভিন্ন ছন্দ বাজান। এই ছন্দবদ্ধ রচনাগুলিকে সিউস বলা হয়, ঐতিহ্যগতভাবে আনুষ্ঠানিক। নাচের এলাকায় ঢোকার পূর্বে, ঢোল বাজায় ছোট ও দ্রুত তালে। সেউ পরিবর্তন করা হয়, এবং ঢাকীরা সাধারণত সারিবদ্ধভাবে নৃত্যের স্থানে প্রবেশ করে। মোহর জিঙ্গর পেপা (সাধারণত শুরুতে) একজন একক বাদক দ্বারা বাজানো হয়, যে একটি প্রাথমিক বাদী মোটিফ তৈরি করে যা নাচের মেজাজ সেট করে। পুরুষ নৃত্যশিল্পীরা তারপর গঠন করে এলাকায় প্রবেশ করে এবং পরিবেশন করে (গানের সাথে, যাতে সবাই অংশগ্রহণ করে)। এই নৃত্যের সাথে অন্যান্য যন্ত্রগুলি হল তাল, এক ধরনের করতাল; গোগোনা, একটি নল-এবং-বাঁশের যন্ত্র; টোকা, একটি বাঁশের তালি এবং ঝুটুলি , একটি মাটির শিস। বাঁশের বাঁশিও প্রায়ই ব্যবহৃত হয়। নৃত্যের সাথে গান (বিহু গীত) প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। গানের বিষয়গুলির মধ্যে রয়েছে অসমীয়া নতুন বছরকে স্বাগত জানানো, একজন কৃষকের জীবন বর্ণনা, ইতিহাস ও ব্যঙ্গ ইত্যাদি। যদিও পুরুষ ও মহিলারা বিহু নৃত্য করে, তবে মহিলা বিহু নৃত্যের আরও বৈচিত্র্য রয়েছে (মুক্তহস্ত, মোচড় সহ, একটি ছন্দময় পেপা সহ, একটি কাহি (ঐতিহ্যবাহী ধাতব প্লেট) এবং একটি জাপি (অসমীয়া শঙ্কুযুক্ত বোনা টুপি) সহ। পারফরম্যান্স দীর্ঘ হতে পারে, কিন্তু তাল, মেজাজ, নড়াচড়া, গতি এবং ইমপ্রোভাইজেশনের দ্রুত পরিবর্তনের দ্বারা এটি প্রাণবন্ত হয়। নৃত্যশিল্পী এবং সঙ্গীতশিল্পীদের তাদের প্রতিভা প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়। প্রকারভেদবিভিন্ন উত্তর-পূর্ব ভারতীয় গোষ্ঠীতে নৃত্যটি বিভিন্ন রূপধারণ করে (যেমন দেউরি বিহু নৃত্য, মিসিং বিহু নৃত্য বা মরানদের দ্বারা পালিত রতি বিহু)।[৬] যদিওচ, নৃত্যের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য একই থাকে: বেদনা ও সুখ উভয়ই অনুভব করার ইচ্ছা প্রকাশ করা। ভোরতাল নৃত্যভোরতাল নৃত্য নরহরি বুরহা ভকত কর্তৃক বিকশিত হয়েছিল বলে জানা যায়। তিনি একজন সুপরিচিত সাত্রিয় শিল্পী ছিলেন। বারপেটা জেলার এই ভোরতাল নৃত্য রাজ্যের শাস্ত্রীয় নৃত্যের ধরন থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে কথিত আছে। এটি আসাম রাজ্যের অন্যতম জনপ্রিয় নৃত্য। পরিবেশন:- এই নৃত্যটি দলবেঁধে পরিবেশিত হয়। সাধারণত ছয় বা সাতজন নৃত্যশিল্পী একসাথে ভোরতাল নৃত্য উপস্থাপন করেন। এই নাচটি বৃহৎ দলেও পরিবেশন করা সম্ভব। এটি খুব দ্রুত বাজনার সাথে পরিবেশিত হয়ে থাকে। এই বাজনাটি 'ঝিয়া ন'ম' নামে পরিচিত। এই নৃত্য পরিবেশন করার সময় নৃত্যশিল্পীরা করতাল নিয়ে সজ্জিত থাকে। করতাল ব্যবহার নাচের উপস্থাপনাকে খুব রঙিন করে তোলে। নাচের গতিবিধি ও তাল এমনভাবে সজ্জিত, যার ফলে এই নৃত্য আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। মূলত এই কারণেই আসামের এই নৃত্য অনন্য। বাগুরুম্বা নৃত্যবাগুরুম্বা আসামে বড়ো জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রচলিত একটি লোকনৃত্য। এটি সাধারণত বিশুব সংক্রান্তিতে (এপ্রিলের মাঝামাঝি) সময়ে অনুষ্ঠিত বোড়ো উৎসব ওয়িসাগুর সময় পরিবেশন করা হয়॥ ওয়িসাগুর আরম্ভ হয় গোপূজা দিয়ে; তারপর, তরুণ-তরুণীরা শ্রদ্ধার সাথে তাদের পিতামাতা ও প্রবীণদের প্রণাম করে। এর পরে, দেবতার উদ্দেশ্যে মুরগি ও জু (ভাতের পচাই) নৈবেদ্য দিয়ে বাথৌ পূজা করা হয়। রঙিন দোখনা ও অরোনাই পরিহিত বোড়ো মহিলারা বাগুরুম্বা নৃত্য পরিবেশন করে (যা বারদ্বিশিখলা নৃত্য নামেও পরিচিত)। এর সাথে থাকে সারজা (একটি নমিত যন্ত্র), সিফুং (বাঁশি), থারখা (বিভক্ত বাঁশ), খাম বা মাদল (কাঠ ও ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি লম্বা ঢোল) ইত্যাদি যন্ত্র। গর্জাশালিতে একটি সার্বজনিক প্রার্থনার মাধ্যমে উৎসবের সমাপ্তি হয়। উদালগুড়ি, কোকড়াঝাড়, বক্সা, চিরাং, বঙ্গাইগাঁও, নলবাড়ি, দরঙ ও সোনিতপুর জেলার বোড়ো-অধ্যুষিত এলাকায় এই নৃত্য পরিবেশিত হয়। ঝুমুর নৃত্যঝুমুর হলো আসামের "আদিবাসী" বা চা উপজাতি সম্প্রদায়ের একটি ঐতিহ্যবাহী নৃত্য।নৃত্যটি তরুণ-তরুণীরা একত্রে পরিবেশন করে। পুরুষ সদস্যরা ঐতিহ্যবাহী দীর্ঘ পোশাক পরে ও কিছু ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র, সাধারণত একটি ঢোল বা মান্দার কাঁধে ঝুলিয়ে, একটি বাঁশি ও এক জোড়া "তাল" (দুটি ধাতব চাকতি) দিয়ে তাল বজায় রাখে। নাচের অংশটি মূলত মেয়েরাই সম্পাদন করে, বাজনার তালে এবং হাত ও পা সামনের দিকে ও পিছনের দিকে করে, একে অপরের কোমর ধরে নৃত্য প্রদর্শন করে।আসামের, উদালগুড়ি, সোনিতপুর, গোলাঘাট, যোরহাট, শিবসাগর, ডিব্রুগড় ও তিনসুকিয়ার মতো "চা উপজাতি" অধ্যুষিত জেলাগুলিতে এই নৃত্যটির অধিক প্রচলন রয়েছে। তথ্যসূত্র
|