করতোয়া নদী
করতোয়া নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী।[১] নদীটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলা এবং বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পঞ্চগড় ও দিনাজপুর জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একটি নদী। নদীটির বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য ১৮৭ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১৩৫ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা "পাউবো" কর্তৃক করতোয়া নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদী নং ১৩।[২] বর্তমান প্রবাহকরতোয়া নদী বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলায় উৎপত্তি লাভ করেছে।[৩] অতঃপর এই নদীর জলধারা বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর ইউনিয়ন দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং দিনাজপুর সদর উপজেলার সরকারপুর ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে আত্রাই নদীতে পতিত হয়েছে।[২] নদীর ইতিহাসকরতোয়া নদী প্রধানত রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের অন্তর্গত একটি ছোট নদী যা একসময় একটি বড় ও পবিত্র নদী ছিল। এর একটি গতিপথ, বর্তমানে যেটির নাম করতোয়া নিম্ন নদী, বগুড়া জেলার মহাস্থানগড় দিয়ে (যা পুণ্ড্রনগর নামে পরিচিত ও প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন নগরীর রাজধানী) প্রবহমান। করতোয়া মাহাত্ম্য এর অতীত ঐতিহ্যের প্রমাণ করে।[৪] মহাভারতে বলা আছে যে, তিনদিন উপবাসের পর করতোয়া নদীতে ভ্রমণ করা অশ্বমেধা (ঘোড়া বলিদান) এর সমান পূণ্যের সমান।[৫] আরেকটি প্রাচীন শহর শ্রাবস্তী, খুব সম্ভবত মহাস্থানগড়ের উত্তরে করতোয়ার পাড়ে অবস্থিত ছিল। অবশ্য শ্রাবস্তীর সম্ভাব্য অবস্থান নিয়ে বিতর্ক আছে।[৬] নামকরণনদীর নামটি দুটি বাংলা শব্দ কর বা হাত এবং তোয়া বা পানির সমন্বয়ে গঠিত। এই নামটি হিন্দু কিংবদন্তির প্রতিফলন করে, যার মতে এই নদীটি পার্বতীকে বিয়ে করার সময় শিবের হাতে ঢালা পানি থেকে তৈরি হয়েছিল।[৭] নদীর গতিপথের পরিবর্তনবাংলা ও এর নিকটবর্তী এলাকার নদীপথের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। উপযুক্ত প্রমাণাদি না থাকলেও সূদুর অতীতেও এমন পরিবর্তন ঘটেছে। করতোয়া নদীর পরিবর্তন বহুবছর ধরে সংঘটিত হয়েছে।[৪] ডানপাশের মানচিত্রটি উত্তর বঙ্গের প্রধান নদী ও এর নিকটবর্তী স্থানসমূহকে প্রদর্শন করে। অপ্রদর্শিত অসংখ্য শাখা ও প্রশাখা প্রধান নদীতে এসে মিশেছে এবং প্রধান নদীর গতিপথের পরিবর্তন এনেছে। নদী-পদ্ধতির নানা পরিবর্তন ক্রমশ সংঘটিত হয়। এছাড়াও অনেক নদীর শাখাগুলো স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন নামে পরিচিত, যা নদী পদ্ধতিটিকে আরো জটিল করে তোলে। টেকটোনিক অসহনশীলতার কারণে করতোয়া নদী চারটি আলাদা ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। উত্তরের অংশটি যার নাম দিনাজপুর-করতোয়া হল আত্রাই নদীর প্রধান উৎস। এটির উৎপন্ন হয়েছে জলপাইগুড়ি জেলার বৈকণ্ঠপুরের একটি জলাধার থেকে এবং মাটির নিচের স্ট্রিম থেকেও পানি গ্রহণ করে। খানসামা উপজেলাতে এটি নাম বদলে আত্রাই হয়ে যায়। দ্বিতীয় শাখার ক্ষেত্রে, দিনাজপুর-করতোয়া খানসামার উত্তরে রংপুর-করতোয়ার সাথে মিশে যায়, অবশ্য এই গতিপথে বর্তমানে খুব সামান্য পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয়। রংপুর-করতোয়ার উপরের অংশ জলপাইগুড়ি জেলায় উৎপন্ন হয়েছে এবং এটি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পর্যন্ত দিওনাই-যমুনেশ্বরী নামে পরিচিত। তৃতীয় শাখা, যমুনেশ্বরী-করতোয়া গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্বের দিকে প্রবাহিত হয় এবং প্রধান গতিপথটি কাটাখালি হয়ে বাঙালি নদীতে গিয়ে পড়ে। প্রাক্তন নদীর একটি অংশ শিবগঞ্জ উপজেলার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং এর বেশির ভাগ অংশ বর্তমানে প্রায় সারাবছর শুষ্ক থাকে। এটি কার্যকরভাবে রংপুর-করতোয়াকে বগুড়া-করতোয়া থেকে পৃথক করে, এবং বগুড়ার দক্ষিণ দিকে থেকে প্রবাহিত হয়ে বাঙালির সাথে মিশে ফুলঝুর নদী নামে হুরাসাগরে গিয়ে পড়ে। চতুর্থ অংশ পাবনা-করতোয়া হান্দিয়াল নিকটবর্তী একটি মৃত নদীগর্ভ। অন্যান্য অনেক চ্যানেলও পুরাতন করতোয়ার অংশ হিসেবে বিবেচিত।.[৭] তিস্তাপ্রাচীনকালে তিস্তা জলপাইগুড়ির দক্ষিণ থেকে তিনটি গতিপথে প্রবাহিত হত, যার পূর্বে করতোয়া, পশ্চিমে পূণর্ভবা এবং কেন্দ্রে আত্রাই। এই তিনটি গতিপথ খুব সম্ভবত নদীটির নাম গঠন করে “ত্রিরস্তা” যা পরবর্তীকালে সংক্ষিপ্ত ও পরিবর্তিত হয়ে তিস্তা নাম ধারণ করে। তিনটি নদীর মধ্যে পুণর্ভবা মহানন্দার সাথে মিলিত হয়। আত্রাই একটি বৃহত্ পানিপরিবেষ্টিত অঞ্চল চলন বিলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে করতোয়ার সাথে মিলিত হয় এবং জাফরগঞ্জের নিকটে পদ্মার সাথে মিলিত হয়। ১৭৮৭ সালের ধ্বংসাত্মক বন্যার পর তিস্তা এর পুরনো গতিপথ বর্জন করে ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হয়।[৪] সিয়ার-আল-মুতাক্কিরিন এ লিপিবদ্ধ হয় যে, করতোয়া গঙ্গার তিনগুণ ছিল যখন বখতিয়ার খিলজি ১১১৫ সালে বাংলার উত্তরাঞ্চল দখল করেন। ভেন ডেন ব্রুকের ১৬৬০ সালে তৈরি বাংলার মানচিত্র অনুসারে করতোয়াকে একটি বৃহত্ গতিপথ হিসেবে দেখানো হয়।[৭] রেনেল ১৭৬৪ ও ১৭৭৭ সালের মধ্যে একটি জরিপ চালান ও বাংলার প্রাচীনতম মানচিত্রগুলোর একটি তৈরি করেন। এই মানচিত্রগুলোতে তিস্তা উত্তর বাংলার বেশ কিছু শাখা পুণর্ভবা, আত্রাই, করতোয়া ইত্যাদির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই সকল শাখাগুলো মহানন্দার নিম্নপ্রান্তে সম্মিলিত হয়, যা বর্তমানে বাংলার সর্বপশ্চিমের একটি নদী এবং হুরসাগর নাম নিয়ে চূড়ান্তে গঙ্গায় বর্তমান গোয়ালন্দের কাছে পতিত হয়। হুরসাগর নদীটি এখনো বড়ালের সাথে, যা গঙ্গা, আত্রাই, যমুনা বা যমুনেশ্বরীর পরিত্যক্ত একটি শাখা, একত্রিত হয়ে বর্তমানে গঙ্গার পরিবর্তে প্রধান যমুনায় পতিত হয়। এ স্থানটি গোয়ালন্দতে পদ্মার সাথে যমুনার মিলনের কয়েক মাইল উপরে অবস্থিত।[৮] কোশিকোশি বা কৌশিকি, যা এখন বিহারের উত্তর-পূর্ব থেকে প্রবাহিত হয় এবং গঙ্গার সাথে রাজমহলের অনেক উপরে মিলিত হয়, প্রাথমিকভাবে পূর্বের দিকে প্রবাহিত হয় ব্রহ্মপুত্রে পতিত হত। কোশির গতিপথ ক্রমাগতভাবে পশ্চিমের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং এটি উত্তর বঙ্গের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে এগিয়ে চলেছে। একসময় কোশি ও মহানন্দা করতোয়ার সাথে মিশে দক্ষিণের মানুষদের থেকে কোচস ও কিরাতাসের উত্তরাঞ্চলীয় মানুষের ভেতরে একটি সীমান্ত গড়ে দিয়েছিল।[৪] চিত্রশালা
আরও দেখুনতথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগউইকিমিডিয়া কমন্সে করতোয়া নদী সংক্রান্ত মিডিয়া রয়েছে।
|