কলম বা লেখনী প্রধানত লেখালেখির কাজে ব্যবহৃত একটি উপকরণ। কলম দিয়ে কাগজ বা কোন পৃষ্ঠতলের উপরে কালি লেপনের কাজ করা হয়। বেশ কয়েক রকমের কলমের মধ্যে বলপয়েন্ট কলম, ঝর্ণা কলম (ফাউন্টেন পেন), ফেল্ট-টিপ কলম, জেল কলম, পালকের কলম (কুইল), খাগের কলম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কলমের ইতিহাস প্রায় ৫ হাজার বছরের পুরানো। ধারণা করা হয়, প্রাচীন মিশরীয়রা সর্বপ্রথম কলম ব্যবহার শুরু করে। সে সময় অবশ্য আজকের মত মসৃণ কোন কাগজ ছিল না। সে সময় লেখালেখি করা হত বিভিন্ন গাছের পাতা, বাকল এবং পশুর চামড়ার উপর। কলম হিসেবে তারা ব্যবহার করত নলখাগড়া, শর বা বেণু, বাঁশের কঞ্চি অথবা ফাঁপা খন্ড। এসব খন্ড কলমের মতো করে কেটে সূচালো করা হত। সূচালো অংশটি কালির মধ্যে চুবিয়ে লেখা হত। কালি বিভিন্ন গাছের রস এবং বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক উপাদান দ্বারা প্রস্তুত করা হত ।
কলমের প্রকার
আধুনিক কলম
কলমের আধুনিক প্রকারভেদগুলো প্রধানত কলমের নিবের উপরে ভিত্তি করে করা হয়েছে।
বলপয়েন্ট কলম - এই কলমের ডগায় বা নিবে ০.৭-১.২ মি.মি. আকারের পিতল, স্টীল বা টাংস্টেন কার্বাইডের তৈরি একটি ছোট্ট শক্ত বল বা গোলক থাকে যা কলমের ভেতরে থাকা কালিকে কাগজ বা যার উপরে লেখা হচ্ছে তাতে মাখাতে সাহায্য করে[১]। বলপয়েন্ট কলমে যে কালি ব্যবহার করা হয় তা একটু ঘন প্রকৃতির এবং তা কাগজের সংস্পর্শে আসতে না আসতেই শুকিয়ে যায়। এই নির্ভরযোগ্য কলমগুলির দামও খুব কম। ফলে সহজেই নিত্যদিনের লেখালেখির কাজে বলপয়েন্ট কলম সবচেয়ে জনপ্রিয় উপকরণ হয়ে উঠেছে।
রোলারবল বা জেল কলম - এই কলমের ডগায়ও বলপয়েন্ট কলমের মত বল থাকে। কিন্তু এই কলমের কালি বলপয়েন্ট কলমের কালির চেয়ে পাতলা বা কম ঘন। এই কম ঘন কালি সহজেই কাগজ শুষে নিতে পারে, এবং কলমও অনেক মসৃণভাবে চলতে পারে। বলপয়েন্ট কলমের সুবিধা এবং ঝর্ণা কলমের কালির ভাবটাকে একত্রিত করার উদ্দেশ্যে জেল কলমের সূত্রপাত হয়েছিল। জেল কালি বিভিন্ন রঙের হয়, এমনকি ধাতব পেইন্ট ও ঝিকিমিকি রঙেরও জেল কালি পাওয়া যায়।
ঝর্ণা কলম - এই কলমে পানি ভিত্তিক তরল কালি দিয়ে নিবের সাহায্যে লেখা হয়। কলমের ভেতরে কালিদানিতে থাকা কালি কৈশিক পরিচলন প্রক্রিয়ায় এবং অভিকর্ষের সাহায্যে নিবের মাধ্যমে বাইরে আসে। এই নিবে কোন নড়নক্ষম অংশ থাকে না, একটা চিকন ফাটল দিয়ে কালি বেরিয়ে আসে। ভেতরের কালিদানিতে কালি শেষ হয়ে গেলে দোয়াত থেকে আবার কালি ভরা যায়। অনেকে মনে করেন ফাউন্টেন পেনের বাংলা তরজমা ঝর্ণা কলম নামটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়েছেন।
ফেল্ট-টিপ কলম বা মার্কার কলম - এই কলমে আঁশ জাতীয় পদার্থের তৈরি স্পঞ্জের মত ডগা থাকে। সবচেয়ে ছোট এবং চিকন ডগার মার্কার কলম দিয়ে কাগজের উপরে লেখা হয়। মাঝারি আকারের ডগা সমৃদ্ধ মার্কারগুলো বাচ্চাদের আঁকাআঁকির জন্য ব্যবহৃত হয়। বড় আকারের ডগার মার্কারগুলো অন্য মাধ্যমে (যেমন কার্ডবোর্ডের বাক্স বা হোয়াইটবোর্ডে) লেখার কাজে ব্যবহার হয়। উজ্জ্বল এবং স্বচ্ছ কালিসহ চওড়া ডগার মার্কার লেখা দাগানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। এদেরকে "হাইলাইটার"ও বলা হয়। বাচ্চাদের জন্য বা হোয়াইটবোর্ডে লেখার জন্য যে মার্কারগুলো তৈরি করা হয়, সেগুলোর কালি সাধারণত অস্থায়ী ধরনের হয়। কিছু মার্কার যেগুলো প্যাকেজিং এবং চালানের বাক্সের গায়ে লেখার কাজে ব্যবহার করা হয় তাদের কালি হয় স্থায়ী।
প্রাচীন কলম
নিব কলম - সাধারণত কাঠের হাতলের সাথে একটি ধাতব নিব লাগিয়ে এই কলম তৈরি করা হয়। নিবটি ঝর্ণা কলমের নিবের মতই, তবে এই কলমে কোন কালি জমা রাখার উপযোগী কালিদানি নেই এবং লেখার সময়ে বারবার এটিকে কালিতে চুবিয়ে নিতে হয়। ঝর্ণা কলমের তুলনায় এই কলমে সুবিধা হল এই কলমে ঘন কালি (যেমন পিগমেন্ট) এবং ধাতব কালি ব্যবহার করা যায় যা ঝর্ণা কলমে জমে গিয়ে আটকে যায় অথবা মরিচা ধরে যায়। নিব কলম এখন প্রধানত অলংকরণ, চারুলিপি এবং কমিকস আঁকার কাজে ব্যবহার হয়।
কালির কলম - পূর্ব এশিয়ার লিপিবিদরা ঐতিহ্যগতভাবে এ ধরনের কলম ব্যবহার করতেন। এদেরকে ব্রাশ বা বুরুশও বলা হয়। কলমের মূল দেহটি সাধারণত বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হত। এছাড়াও বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু দুর্লভ উপকরণ যেমন - লাল চন্দন গাছ, কাচ, হাতির দাঁত, সোনা, রূপা প্রভৃতিও ব্যবহার করা হত। কলমের শীর্ষভাগটি বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর (যেমনঃ বেজি, শুকর, বাঘ, মোরগ) পাখা ও লোম হতে তৈরি করা হত।এককালে চীন এবং জাপান উভয় স্থানেই নতুন জন্ম নেওয়া শিশুর চুল দিয়ে এ ধরনের কলম তৈরি করার রেওয়াজ ছিল, যাদেরকে সারা জীবনের জন্য স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দেখা হত।
কুইল বা পালকের কলম - সাধারণত রাজহাঁস বা বড়সড় পাখির পালকেরতৈরি কলমকে কুইল (quill) বলে। ডিপ কলম, ঝর্ণা কলম ইত্যাদি আসার আগে কুইল ব্যবহৃত হত। পালকের ফাঁপা অংশ কালিদানি হিসেবে কাজ করত এবং কৈশিক পরিচলন প্রক্রিয়ায় কালির পরিচলন হত। মধ্যযুগে পার্চমেন্ট বা চামড়ার কাগজের উপরে কুইল দিয়ে লেখা হত। পালকের কলম বা কুইল এসে খাগের কলমকে প্রতিস্থাপিত করেছিল।
খাগের কলম - খাগ বা নলখাগড়া, বাঁশ ইত্যাদির একদিক সরু করে কেটে মাথাটা সূক্ষভাবে চিরে এই কলম তৈরি করা হত। এর যান্ত্রিক প্রক্রিয়া কুইলের মত।
প্রাচীন মিশরীয়রা সমুদ্রের রাশ থেকে পাতলা রিড ব্রাশ বা রিড কলম ব্যবহার করত[২]।
স্টিভেন রজার ফিশার তার এ হিস্ট্রি অফ রাইটিং বইয়ে সাক্কারার সন্ধানের ভিত্তিতে পরামর্শ দিয়েছেন যে, প্রায় ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পার্চমেন্টে লেখার জন্য রিড কলম ব্যবহার করা হত। মধ্যযুগ পর্যন্ত রিড কলম ব্যবহার করা অব্যাহত ছিল, কিন্তু প্রায় ৭ ম শতাব্দী থেকে ধীরে ধীরে কুইল দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।[৩][৪]
চামড়া, ভেলাম এবং পার্চমেন্ট দ্বারা প্যাপিরাস লেখার পৃষ্ঠ হিসাবে প্রতিস্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত খাগড়া কলম টিকে ছিল। প্রায় ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কুইল কলম জুডিয়ার কুমরানে ব্যবহৃত হত মৃত সাগরের স্ক্রোল লিখতে। স্ক্রোলগুলি হিব্রু উপভাষায় পাখির পালক বা কুইল দিয়ে লেখা হয়েছিল।.[৫]
পম্পেইয়ের ধ্বংসাবশেষে একটি তামার নিব পাওয়া গেছে, যা দেখায় যে ৭৯ সালে ধাতব নিব ব্যবহার করা হত[৬]
৯৫৩ সালে, মিশরের ফাতেমীয় খলিফা মা'আদ আল-মুইজ একটি কলম চেয়েছিলেন যা তার হাত বা কাপড়ে দাগ ফেলবে না, এবং একটি ফাউন্টেন কলম সরবরাহ করা হয়েছিল যা একটি জলাধারে কালি ধারণ করে নিবের কাছে পৌঁছে দেয়। [৭] এর প্রক্রিয়াটি অজানা থেকে যায় এবং এটি উল্লেখ করার শুধুমাত্র একটি রেকর্ড পাওয়া গেছে।
১৬৩৩ সালের আগস্টের স্যামুয়েল পেপিসের ডায়েরিতে 'কালি বহন করার জন্য একটি রূপালী কলম'-এর উল্লেখ রয়েছে।
১৬৩৬ সালে পরবর্তীতে একটি জলাধার কলম তৈরি করা হয়েছিল।জার্মান উদ্ভাবক ড্যানিয়েল শোয়েন্টার কুইল থেকে তৈরি একটি কলম বর্ণনা করেছেন,একটি কুইল অন্য কুইলের ভিতরে কালির আধার হিসেবে কাজ করত। ১৮০৯ সালে, বার্থোলোমিউ ফলস কালি আধার সহ কলমের জন্য ইংল্যান্ডে একটি পেটেন্ট পেয়েছিলেন।
প্যারিসের একজন ছাত্র, রোমানিয়ান পেট্রাচে পোয়েনারু ফাউন্টেন কলম আবিষ্কার করেছিলেন যা কালি জলাধার হিসাবে একটি কুইল ব্যবহার করেছিল।[৮] ফরাসি সরকার ১৮২৭ সালের মে মাসে এটি পেটেন্ট করে। ১৮৫০-এর দশকে ফাউন্টেন পেনের পেটেন্ট এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।জন জে লাউড বলপয়েন্ট কলমের প্রথম পেটেন্ট করেন।
↑Bosworth, C. E. (Autumn ১৯৮১), "A Mediaeval Islamic Prototype of the Fountain Pen?", Journal of Semitic Studies, XXVI (i)উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)