ভিক্ষাটন
ভিক্ষাটন (সংস্কৃত: भिक्षाटन; Bhikṣāṭana; আক্ষরিক অর্থে, ‘‘ভিক্ষার্থে পরিব্রাজন বা তীর্থপর্যটন’’[১]) বা ভিক্ষাটনমূর্তি (Bhikṣāṭanamūrti) হলেন "পরম পরিব্রাজক (ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসী)"[২] বা "পরম ভিক্ষুক"[৩] রূপে হিন্দু দেবতা শিবের এক বিশেষ মূর্তি। এই মূর্তিতে শিব নগ্ন, চতুর্ভূজ, নানা অলংকারে ভূষিত ও ভিক্ষাপাত্রধারী; অনুগত ভূতপ্রেত ও কামার্ত নারীগণকে এই মূর্তিতে তার অনুচররূপে দেখা যায়। হিন্দুশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, ভিক্ষাটন হলেন শিবের ভয়ংকর রূপ ভৈরবের একটি শান্ত মূর্তি। ভৈরবের দু’টি ভয়ংকর রূপের উল্লেখ পাওয়া যায়। একটি রূপে তিনি ব্রহ্মার শিরশ্ছেদ করেছিলেন এবং অপর রূপে তিনি বিষ্ণুর দ্বাররক্ষক বিশ্বকসেনকে হত্যা করেন। ভিক্ষাটন রূপটি হল ভৈরবের এই দুই ভয়ংকর রূপের মধ্যবর্তী পর্যায়।[৪] হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তক ছেদনের পাপ স্খালন করতে ভৈরব ভিক্ষাটন রূপ ধারণ করেছিলেন। তারপর নগ্ন কপালী বা কাপালিকের বেশ ধারণপূর্বক তিনি ব্রহ্মাণ্ড পরিভ্রমণ শুরু করেন এবং ব্রহ্মার করোটিকে (মাথার খুলি) ভিক্ষাপাত্র হিসাবে ব্যবহার করে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেন। শেষে পবিত্র বারাণসী নগরীতে উপনীত হয়ে তিনি কৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে ভিক্ষাটন রূপ পরিত্যাগ করেন। অপর এক কিংবদন্তি অনুসারে, ভিক্ষাটন ঋষিদের অজ্ঞতা দূর করতে এবং তাঁদের সত্য জ্ঞানের পথে পরিচালিত করতে দারুকবনে গমন করেন। সেখানে তাঁকে ভিক্ষা দিতে উপস্থিত হওয়া ঋষিপত্নীদেরকে তিনি প্রলুব্ধ করেন। ভিক্ষাটনের সেই ‘‘পাষণ্ডোচিত’’ মূর্তি ও কার্যে ভীত হয়ে ঋষিগণ তার সঙ্গে এক দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত ভিক্ষাটনই জয়লাভ করেন এবং তার বিমূর্ত প্রতীক লিঙ্গের পূজা প্রবর্তন করেন। এই কিংবদন্তিরই একটি পাঠান্তরে পাওয়া যায়, ভিক্ষাটন নৃত্যাধিশ্বররূপে নটরাজ রূপ ধারণ করেছিলেন। ভিক্ষাটন মূর্তিটি দক্ষিণ ভারতে জনপ্রিয় হলেও উত্তর ভারতে এই রূপটির গুরুত্ব অল্পই। ভিক্ষাটনের পৃথক কোনও মন্দির না থাকলেও অনেক প্রস্তরনির্মিত মন্দিরগাত্রে তার মূর্তি খোদিত থাকে, তিনি পূজিত হন আবরণ-দেবতা বা পার্শ্ব-দেবতারূপে এবং প্রায় প্রতিটি প্রধান তামিল শিব মন্দিরের উৎসবে তার ব্রোঞ্জনির্মিত মূর্তি শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে। অনেক তামিল স্তোত্রে ভিক্ষাটনের পরিব্রাজনের কাহিনি গীত হয়েছে। বহু স্তোত্রেই প্রতিধ্বনিত হয়েছে তার রূপে মোহিত নারীর হৃদয়ব্যাকুলতা। কিংবদন্তিপ্রায়শ্চিত্তকল্পে পরিব্রাজনকূর্মপুরাণ অনুযায়ী, ঋষিদের এক সমাবেশে সৃষ্টিকর্তা দেবতা ব্রহ্মা সদম্ভে নিজেকে ব্রহ্মাণ্ডের পরম স্রষ্টা বলে ঘোষণা করেন। তখন শিব সেই সমাবেশে এক অনন্ত আলোকস্তম্ভরূপে উপস্থিত হয়ে তার কথার বিরোধিতা করেন। বিচারবিবেচনার পর ঋষিগণ শিবকেই পরম স্রষ্টারূপে স্বীকার করে নেন। কিন্তু ব্রহ্মা নিজের মতে অনড় থাকেন। ব্রহ্মার অহংকারে ক্রুদ্ধ শিব ভয়ংকর ভৈরবের রূপ ধারণ করে পঞ্চমস্তক ব্রহ্মার একটি মস্তক শুধুমাত্র অঙ্গুলিচালনায় ছেদন করেন (এই মূর্তিটি মূর্তিতত্ত্বে বিবৃত হয়েছে "ব্রহ্মাশিরশ্ছেদমূর্তি" নামে)। ফলে ব্রহ্মার মৃত্যু ঘটে। কিন্তু কঠোর তপস্যাবলে সারা জীবনে তিনি যে আধ্যাত্মিক পূণ্য অর্জন করেছিলেন, তার বলে তৎক্ষণাৎ তিনি মৃত্যুপুরি থেকে ফিরেও আসেন। পুনর্জীবনলাভের পর ব্রহ্মা অবশ্য শিবের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নেন।[৫][৬] শিবপুরাণ ও মৎস্যপুরাণেও শিব কর্তৃক ব্রহ্মার শিরশ্ছেদের এই কারণই বর্ণিত হয়েছে। স্কন্দপুরাণে অবশ্য বলা হয়েছে, অহংকার নয়, বরং নিজ কন্যার সঙ্গে অজাচারের শাস্তিস্বরূপ শিব ব্রহ্মার শিরশ্ছেদ করেছিলেন। শিবপুরাণের বঙ্গীয় পাঠে অবশ্য অন্য একটি উপাখ্যানের সন্ধান পাওয়া যায়। এই কাহিনি অনুসারে, একবার শিব অতিথিরূপে ব্রহ্মলোকে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেই সময় ব্রহ্মার চারটি মস্তক শিবের স্তবগান করলেও পঞ্চম মস্তকটি তাঁকে অপমান করেছিল। তাই ক্রুদ্ধ শিব সেই মস্তকটি ছেদন করেন। শিবপুরাণে ব্রহ্মার আরও একটি অপরাধের কথা উল্লেখ রয়েছে। একবার ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মধ্যে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বিবাদ বাধে। তখন শিব তাঁদের সামনে এক অনন্ত জ্যোতির্লিঙ্গরূপে আবির্ভূত হন। স্থির হয়, যিনি সেই লিঙ্গের অন্ত খুঁজে পাবেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হবেন। ব্রহ্মা সেই লিঙ্গের শীর্ষভাগ খুঁজে পাওয়ার মিথ্যা দাবি করে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করেন। বরাহপুরাণ মতে, ব্রহ্মার ললাট থেকে শিবের জন্ম। তাই ব্রহ্মা তাঁকে "কপালী" সম্বোধন করলে শিব ক্রুদ্ধ হন। শিরশ্ছেদ-উপাখ্যানের সকল পাঠেই দেখে যায় যে, ক্রুদ্ধ শিব বা ভৈরব শাস্তি হিসাবে ব্রহ্মার শিরশ্ছেদন করেছেন।[৭][৮] যদিও সকল পুরাণেই (কূর্ম, বরাহ, শিব, স্কন্দ ও বামন) বলা হয়েছে যে, ব্রহ্মা হলেন ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ। তাই ব্রহ্মহত্যার পাপে ব্রহ্মার মস্তকটি ভৈরব-শিবের বাম করতলে আটকে যায়। সেই পাপ স্খালনের জন্য শিব কাপালিকের ব্রত গ্রহণ করেন এবং ব্রহ্মার করোটিকে ভিক্ষাপাত্র করে নগ্ন ভিক্ষুকের বেশে ব্রহ্মাণ্ড পরিব্রাজন শুরু করেন।[৫][৬] কূর্ম ও বামনপুরাণে আরও বলা হয়েছে যে, শিবের পাপটি শারীরিকরূপ ধারণ করে এবং ব্রহ্মহত্যা নামে এক পিশাচিনী সর্বত্র ভিক্ষাটনকে অনুসরণ করতে থাকে।[৯] কূর্মপুরাণের বিবরণ অনুযায়ী, ভিক্ষাটন ভূতগণকে সঙ্গে নিয়ে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে ত্রিলোক (স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল) পর্যটন করেন। গৃহবধূরা অন্ন ভিক্ষা দিতে এসে তার রূপে মোহিত হয়ে নৃত্যগীত করতে করতে তাঁকে অনুসরণ করতেন।[৬] ভ্রমণ করতে করতে ভিক্ষাটন উপস্থিত হলেন দারুকবনে বা দারুবনে (দেবদারু বন)। সেখানে ঋষিগণ তার "লাম্পট্য ও নগ্নতা" দেখে হতবাক হয়ে গেলেন এবং তাঁদের পত্নীগণ ভিক্ষাটনকে দেখে প্রলুব্ধ হলেন। ঋষিগণের সঙ্গে সংঘাতের পর ভিক্ষাটন-শিব তাঁদের উপলব্ধি করালেন নিজের শ্রেষ্ঠত্ব।[৫][৬] যদিও অন্য কয়েকটি পুরাণে দেখা যায়, এই সংঘাতের ঘটনাটি অন্য সময়ে ঘটেছিল এবং এটির সঙ্গে ভিক্ষাটনের পাপ স্খালন যাত্রার কোনও সম্পর্ক নেই। কূর্মপুরাণ মতে, দারুকবনে ঋষিদের সঙ্গে সংঘাতের পরে ভিক্ষাটন পুনরায় ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। দেব ও দৈত্যদের নানা রাজ্য পর্যটনের পর শেষ পর্যন্ত তিনি বিষ্ণুলোকে উপস্থিত হন। বিষ্ণুর দ্বাররক্ষী বিশ্বকসেন তাকে সেখানে প্রবেশে বাধা দেন। ক্রুদ্ধ হয়ে ভিক্ষাটন বিশ্বকসেনকে হত্যা করেন এবং তার মৃতদেহ নিজের ত্রিশূলে গেঁথে নেন। এর ফলে তার পাপের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায়। ত্রিশূলে মৃতদেহ গাঁথা অবস্থায় শিবের যে রূপ, তাকে বলে "কঙ্কালমূর্তি" ("কঙ্কালধারী")। এই কঙ্কালমূর্তি বেশে ভিক্ষাটন বিষ্ণুলোকে প্রবেশ করে অন্ন ভিক্ষা করেন। একটি পাঠে পাওয়া যায়, বিষ্ণু নিজের রক্ত খাদ্য হিসাবে তাঁকে প্রদান করেছিলেন। অপর একটি পাঠ থেকে জানা যায়, বিষ্ণু ভিক্ষাটনের কপালের একটি ধমনী কেটে দেন এবং সেখান থেকে রক্তধারা নিঃসৃত হয়ে তার ভিক্ষাপাত্রে খাদ্য হিসাবে সঞ্চিত হয়। তারপর বিষ্ণুর নির্দেশেই নিজের পাপ স্খালনে ভিক্ষাটন পবিত্র নগরী বারাণসীতে উপস্থিত হন।[৫][৬][১০] বামনপুরাণ এবং মৎস্যপুরাণেও বিষ্ণুর দ্বাররক্ষীর সঙ্গে ভিক্ষাটনের সংঘাতের ঘটনাটি একটু পৃথকভাবে পুনর্কথিত হয়েছে।[১১] সকল পুরাণেই কথিত হয়েছে যে, বারাণসীতে পৌঁছে অধুনা "কপালমোচন" ("করোটির থেকে মুক্তি") নামে পরিচিত একটি স্থানে ব্রহ্মার করোটি ভিক্ষাটনের হাত থেকে পড়ে যায় এবং সেই সঙ্গে বিশ্বকসেনের মৃতদেহটিও অদৃশ্য হয়ে যায়। ব্রহ্মহত্যারূপে আবির্ভূত পাপটিও নরকে অন্তর্হিত হয়। বিশ্বকসেন পুনর্জীবন লাভ করেন। বারাণসীর পবিত্র পুষ্করিণীতে স্নান করে পাপমুক্ত ভৈরব-শিব ভিক্ষাটনের বেশ পরিত্যাগপূর্বক নিজ লোকে গমন করেন।[৫][৬][১০] দেবদারু বনে গমনকূর্মপুরাণেই কথিত হয়েছে যে, ঋষিগণ ধর্মপালন ও কঠোর তপস্যায় আত্মনিয়োগ করলেও সাংখ্য (পরম জ্ঞান) বিস্মৃত হন। সেই সময় ভিক্ষাটন-শিব তাঁদের অজ্ঞতা উন্মোচিত করতে ইচ্ছাপোষণ করেন। নগ্ন, সুদর্শন, ঊর্ধ্বলিঙ্গ ভিক্ষুক বেশে শিব অরণ্যে প্রবেশ করেন এবং ঋষিপত্নীদের কাছে ভিক্ষা প্রার্থনা করেন। ভিক্ষাদানের সময় তারা ভিক্ষাটনের রূপে এমন মোহিত হলেন যে, নিজেদের পরিধেয় বস্ত্র পরিত্যাগ করে প্রেমার্ত হয়ে নৃত্যগীত শুরু করলেন। মোহিনী-বিষ্ণু ভিক্ষাটনের মন্ত্রমুগ্ধকারিণী স্ত্রীর ছদ্মবেশে তার সঙ্গে এসেছিলেন। তিনি ঋষিপুত্রদের প্রেমে উন্মাদ করে তুললেন। শিবকে চিনতে না পেরে ঋষিরা তাঁকে কটুকাটব্য করলেন, অভিশাপ দিলেন, এমনকি আক্রমণও করলেন। তারা অভিশাপ দিলেন যে, ভিক্ষাটনের পুরুষাঙ্গ (লিঙ্গ) খসে পড়বে। শিব তা হতে দিলেন এবং লিঙ্গটি আলোকের অনন্ত জ্যোতির্ময় স্তম্ভের রূপ ধারণ করল। ঋষি অত্রির পত্নী অনুসূয়া ঋষিদের অবহিত করেন যে, এই যুগল শিব ও বিষ্ণু ছাড়া কেউ নন। এরপর ঋষিগণ লিঙ্গের পূজা করলেন। সন্তুষ্ট হয়ে শিব তার পত্নী পার্বতীকে নিয়ে একটি কুৎসিত রূপ ধারণ করে ভিক্ষুকের বেশে বনে ফিরে গেলেন। ঘটনাচক্রে তিনি নিজের পরম রূপটি ঋষিদের সম্মুখে প্রকাশ করেন এবং পাশুপত ব্রত প্রচার করেন। এই ব্রত পালনে পুরুষ নিজের কামনা-বাসনা প্রতিহত করতে পারেন, ব্রহ্মচারী হয়ে শরীরে ভস্ম মেখে নগ্ন অবস্থায় ভ্রমণ করেন। এইভাবে তিনি এমন এক জীবন যাপন করেন যা তাঁকে মোক্ষ লাভের পথে নিয়ে যায়।[১২][১৩] অন্যান্য ধর্মগ্রন্থেও অন্য সময়ে শিবের ভিক্ষাটন বেশে দারুকবনে আগমনের উল্লেখ পাওয়া যায়। বামনপুরাণে আছে, শিব ভিক্ষুকের বেশে দুইবার দারুকবনে গিয়েছিলেন। প্রথমা পত্নী সতীর মৃত্যুতে শোকে উন্মত্ত এবং প্রেমের দেবতা কামদেব কর্তৃক তাড়িত অবস্থায় শিব দারুকবনে পালিয়ে আসেন ও সেখানে ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসীর বেশে বসবাস করতে থাকেন। ঋষিপত্নীরা তাঁকে অন্ন ভিক্ষা দিতে এসে তাঁকে দেখামাত্র কামার্ত হয়ে পড়েন। তখন ঋষিদের অভিশাপে ভিক্ষাটনের লিঙ্গ খসে পড়ে একটি অনন্ত স্তম্ভের রূপ ধারণ করেন। ব্রহ্মা ও বিষ্ণু তাঁকে প্রসন্ন করেন এবং শিব লিঙ্গটি পুনরায় নিজ শরীরের সঙ্গে যুক্ত করেন। আরেকটি ঘটনায় দেখা যায়, দারুকবনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পার্বতী দেখেন ঋষিগণ শিবের পূজা করছেন। তাঁদের শরীর উপবাস ও কঠোর ব্রতপালনে দুর্বল হয়ে পড়েছে। পার্বতী শিবকে অনুরোধ করেন তারা যেন আর যন্ত্রণা না পান। কিন্তু শিব বলেন যে ওই ঋষিরা মূর্খ। কারণ, তারা নিজেদের কামনাবাসনা ও ক্রোধ নিবারণ করতে পারেননি। তাই তিনি শুধুমাত্র বনফুলের মালা পরে এক সুদর্শন পুরুষ রূপে অরণ্যে প্রবেশ করেন এবং তাঁকে ভিক্ষা দিতে আসা ঋষিপত্নীদের প্রলুব্ধ করেন। পূর্বের মতো এই ক্ষেত্রেও অভিশপ্ত শিবের লিঙ্গটি খসে পড়ে। কিন্তু ঘটনাচক্রে ঋষিগণ তাঁদের মূঢ়তা উপলব্ধি করেন এবং সেই লিঙ্গের পূজা করেন।[২][১৪] মহাভারত, শিবপুরাণ ও ভাগবত পুরাণে ভ্রান্ত ঋষিদের নম্রতা ও জ্ঞান প্রদানের উদ্দেশ্যে ভিক্ষাটন-শিবের দারুকবনে গমন, তার লিঙ্গ খসে পড়া এবং লিঙ্গ উপাসনা প্রবর্তনের অনুরূপ উপাখ্যান পাওয়া যায়।[১৫] ঋষিদের কঠোর তপস্যা সুস্থ সামাজিক ব্যবস্থা রক্ষণের পক্ষে ক্ষতিকারক প্রতিপন্ন হলে, তাঁদের পত্নীদের প্রলুব্ধ করতে ভিক্ষাটন-শিবের দারুকবনে আগমনের উল্লেখ লিঙ্গপুরাণেও পাওয়া যায়।[১৬] শাস্ত্রে ভিক্ষাটন-শিবের বিকৃত অথচ আকর্ষণীয় নগ্ন কৃষ্ণ-লোহিত রূপ, ঋষিপত্নীদের প্রলুব্ধকরণ এবং ফলাফলস্বরূপ ঋষিদের অভিশাপের কথা উল্লেখ আছে। যদিও এই গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে যে, সেই অভিশাপ ব্যর্থ হয়েছিল। বিমূঢ় ঋষিগণ ব্রহ্মার সহায়তা প্রার্থনা করলে ব্রহ্মা তাঁদের সেই ভিক্ষুকের প্রকৃত রূপের বর্ণনা করলেন এবং সঠিক উপায়ে শিবকে তুষ্ট করার পদ্ধতি শিক্ষা দিলেন। বনে ফিরে তারা ভিক্ষা চাইতে পুনরাগত শিবকে সন্তুষ্ট করলেন। শেষ পর্যন্ত নিজের সত্য রূপ প্রকাশ করে তিনি ঋষিদের জ্ঞানালোকে আলোকিত করলেন।[১৭][১৮] পদ্মপুরাণে কথিত হয়েছে, ঋষিদের অভিশাপ ব্যর্থ হয়েছিল। তাঁদের শাস্তি দিতে শিব অভিশাপ দেন যে, ভিক্ষাটনের মতো তারাও জটাধারী ভিক্ষুকে পরিণত হবেন এবং জ্ঞানলাভে বঞ্চিত হবেন। তারপরেও যাঁরা তার পূজা করবেন তারা জ্ঞান, ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি লাভ করবেন এবং সৎ পরিবারে পুনর্জন্ম লাভ করবেন।[১৯] স্কন্দপুরাণে আছে, দারুকবনে যজ্ঞ শুরুর পর ঋষিরা নিজেদেরকে দেবতাসম মনে করতে শুরু করেন। তাঁদের দর্প চূর্ণ করতে শিব মনোমুগ্ধকর তরুণ ভিক্ষুক ভিক্ষাটনের রূপ এবং বিষ্ণু মোহিনী বেশে তার পত্নীর রূপ ধারণ করেন। ঋষিরা মোহিনীর রূপে আকৃষ্ট হলেন এবং নারীরা পাগলের মতো শিবের পিছনে পিছনে ছুটতে শুরু করলেন। ঋষিগণ যখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেন, তখন তারা একটি মায়াযজ্ঞের আয়োজন করলেন। এই যজ্ঞ থেকে একটি সাপ, একটি সিংহ, একটি হাতি (অথবা বাঘ) এবং এক বামনের উৎপত্তি ঘটল। তারা সবাই শিবকে আক্রমণ করল। কিন্তু শিব তাদের পরাজিত করলেন। তারপর শিব সেই বামনের উপর উঠে নৃত্যাধিপতি নটরাজের বেশে নৃত্য শুরু করেন।[২০] তামিল কোবিল পুরাণম ও কন্দ পুরাণম গ্রন্থেও কিছু পাঠান্তরসহ একই কিংবদন্তির উল্লেখ আছে।[২১][২২][২৩] শিব-নটরাজের প্রতি উৎসর্গিত চিদাম্বরম মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত স্থলপুরাণেও এই কিংবদন্তির উল্লেখ আছে।[২৪] নটরাজ মন্দির চত্বরে শিবকামসুন্দরী মন্দিরের সিলিংয়ে পরপর একাধিক ফ্রেস্কোতে এই কিংবদন্তিটি বর্ণিত হয়েছে। এই ফ্রেস্কোগুলিতে ভিক্ষাটনকে দেখা যায় শ্বেতকায় নগ্ন ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসীর বেশে এবং তার সঙ্গে থাকেন স্বল্পবসনা মোহিনী।[২৫] কপালেশ্বর কিংবদন্তিস্কন্দপুরাণে আছে, ভিক্ষাটন-শিব আরেকটি ক্ষেত্রে ভয়াল দর্শন নগ্ন কাপালিক ভিক্ষুকের বেশে আবির্ভূত হয়েছিলেন। একবার ব্রহ্মা যখন যজ্ঞ করছিলেন, সেই সময় ভিক্ষাটন সেখানে এসে অন্ন ভিক্ষা করেন। যজ্ঞ-সম্পাদনাকারী ব্রাহ্মণেরা ক্ষুধার্ত ভিক্ষুককে যজ্ঞভূমিতে অবাঞ্ছিত জ্ঞানে তাঁকে বিতাড়িত করেন। ভিক্ষাটন তার কপালপাত্রটি মাটিতে নিক্ষেপ করলে ব্রাহ্মণেরা সেটিকেও বাইরে ফেলে দেন। কিন্তু সেই স্থানে আরেকটি কপালপাত্রের উদ্ভব ঘটে। এইভাবে শত শত নরকরোটির উদ্ভব ঘটলে যজ্ঞক্ষেত্র দূষিত হয়ে পড়ে। ফলে ব্রহ্মা শিবকে কথা দিতে বাধ্য হন যে, "কপালেশ্বর" ("নরকরোটির অধিপতি") রূপে তাঁকে আবাহন না করলে কোন যজ্ঞই সম্পূর্ণ হবে না।[২৬] মূর্তিতত্ত্বঅংশুমদভেদাগম, কামিকাগম, সুপ্রেদাগম, কারণাগম ও মূর্তিতত্ত্ব সংক্রান্ত গ্রন্থ শিল্পরত্ন-সহ সকল শৈব আগম গ্রন্থে ভিক্ষাটনের মূর্তিতত্ত্ব আলোচিত হয়েছে। এই গ্রন্থগুলির অধিকাংশই দক্ষিণ ভারতে রচিত।[২৭] ভিক্ষাটনের মূর্তিতত্ত্ব কঙ্কালমূর্তি রূপেরই অনুরূপ। ভিক্ষাটনের মতো কঙ্কালমূর্তিও ব্রহ্মার শিরশ্ছেদের পর শিবের পাপ স্খালনের কিংবদন্তিটির সঙ্গে যুক্ত। দুই মূর্তির প্রধান পার্থক্যটি হল এই যে, ভিক্ষাটন নগ্ন এবং কঙ্কালমূর্তি বস্ত্র-পরিহিত।[২৮] শিবকে প্রায়শই নগ্ন যোগী সন্ন্যাসীরূপে বর্ণনা করা হয়। তবে ভিক্ষাটন মূর্তি ছাড়া অন্যত্র মূর্তিতত্ত্বে তাঁকে খুব কমই নগ্নরূপে প্রদর্শন করানো হয়েছে।[১৬] অনেক ক্ষেত্রেই নগ্ন ভিক্ষাটনের প্রলুব্ধকর প্রকৃতিটির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তার বক্ষ, উদর ও পশ্চাদ্দেশের রূপায়নের মাধ্যমে। তার পুরুষাঙ্গ সম্পূর্ণ দৃশ্যমান হলেও দক্ষিণ ভারতীয় কোনও মূর্তিকল্পেই তাঁকে ঊর্ধ্বলিঙ্গ অবস্থায় প্রদর্শিত করা হয়নি।[২][২৯] শাস্ত্রীয় বিবরণের বিপরীতে, ভিক্ষাটনের ওড়িশি চিত্রণে তাঁকে ব্যাঘ্রচর্মপরিহিত ও অন্যান্য অলংকারে ভূষিত অবস্থায় দেখা যায়। কিন্তু এই সব চিত্রে বা মূর্তিতে তার ঊর্ধ্বলিঙ্গও প্রদর্শিত হয়। এখানে তিনি দ্বিভূজ; তার বাঁহাতে থাকে ভিক্ষার কপালপাত্র এবং ডানহাতে থাকে ত্রিশূল।[৩০] ভিক্ষাটনকে জটাভদ্র (এলোমেলো জটা) অথবা জটামণ্ডল (চক্রাকারে নিবদ্ধ জটা)-সহ বর্ণনা করা হয়। কখনও কখনও তার জটায় একটি সাপ দেখা যায়। এছাড়া, জটায় একটি অর্ধচন্দ্রও শোভা পায়। কপালে শৈব তিলক ত্রিপুণ্ড্র আঁকা হয়। পবিত্র ভস্মের তিনটি অনুভূমিক রেখা এবং তার মধ্যে তৃতীয় নয়নের প্রতীক একটি লাল বিন্দু দিয়ে এই ত্রিপুণ্ড্র আঁকা হয়। তিনি পাট্টা (অলংকারখচিত মস্তকাবরণী) পরিধান করেন। কখনও কখনও কপালে মানব করোটির চিত্রও আঁকা হয়। সর্পালঙ্কারে তার শরীর ভূষিত। ব্রোঞ্জ মূর্তিগুলিকে বিভিন্ন ধরনের কণ্ঠহার, কটিবন্ধনী, বাজুবন্ধ, বালা, নূপুর এবং হাতের ও পায়ের আঙুলে একাধিক আংটি দেখা যায়। তার কোমরে একটি সাপ পেঁচানো থাকে এবং বুকে একটি সাদা যজ্ঞোপবীত ঝোলানো থাকে।[২৮][২৯] দক্ষিণ ভারতীয় মূর্তিতত্ত্বে ভিক্ষাটনকে প্রায়শই চতুর্ভূজরূপে প্রদর্শিত হয়। তার সম্মুখের ডান হাতটি নিচের দিকে ঝোলানো অবস্থায় থাকে এবং সেই হাতে কটক মুদ্রায় সামান্য ঘাস বা অন্য কোনও লতা তিনি তার পাশে ক্রীড়াচ্ছলে লাফ দেওয়া পোষ্য হরিণ বা কৃষ্ণসারের মুখের কাছে ধরেন।[২৮][২৯][৩১][৩২] পিছনের ডান হাতটি উত্তোলিত অবস্থায় একটি ডমরু ধরে থাকে। সামনের বাঁ হাতটি ভিক্ষাপাত্র হিসাবে ব্যবহৃত একটি কপালপাত্র ধরে থাকে। পিছনের বাঁ হাতটিতে থাকে ময়ূরের পালকশোভিত একটি ত্রিশূল। বাঁ পাটি মাটিতে দৃঢ়ভাবে স্থাপিত অবস্থায় থাকে। অন্যদিকে ডান পাটি সামান্য বাঁকা অবস্থায় থাকে। পায়ের এই ভঙ্গিমার মাধ্যমে তার পরিব্রাজন বোঝানো হয়।[২৮][৩০] অনেক ক্ষেত্রেই তার পায়ে খড়ম (কাঠের জুতো) দেখা যায়। তবে কোনও কোনও মূর্তিতে তাঁকে খালি পা অবস্থাতেও দেখা যায়।[২৮] এই খড়মগুলি স্বতন্ত্র প্রকৃতির হয়, যা ভিক্ষাটনের মূর্তিতত্ত্বের বৈশিষ্ট্যগুলিকে সূচিত করার মাধ্যমে সর্বদা নগ্নপদ মূর্তিতে থাকা শিব ও অন্যান্য দেবতা থেকে তার পার্থক্য নির্দেশ করে।[২৯][৩৩] কখনও কখনও ভিক্ষাটনের মূর্তিতত্ত্বের সঙ্গে ভৈরবের মূর্তিতত্ত্ব মিশ্রিত হয়ে যায়। সেই ক্ষেত্রে ভিক্ষাটনের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলির সঙ্গে ভৈরবের বৈশিষ্ট্যই একই মূর্তিতে প্রকাশিত হয়।[৩৩][৩৪] ভিক্ষাটনের একটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ শাস্ত্রে না থাকলেও প্রস্তরনির্মিত ও ব্রোঞ্জনির্মিত মূর্তিগুলিতে দেখা যায়। সেটি হল - তার ডান হাঁটুর ঠিক নিচে সুতোয় বাঁধা একটি ছোটো ঘণ্টার উপস্থিতি।[২৮] বিশেষজ্ঞ মহাদেব চক্রবর্তী এই ঘণ্টাটিকে ভিক্ষাটনের অস্পৃশ্য পরিচিতির প্রতীক বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ, ঘণ্টা হল দক্ষিণ ভারতের পারিয়া অস্পৃশ্যদের প্রতীক। রীতি অনুযায়ী, ব্রাহ্মণ-অধ্যুষিত গ্রামে প্রবেশের সময় তাঁদের ঘণ্টা বাজাতে হত।[৩৫] ব্রোঞ্জ মূর্তিতে হরিণ ও ত্রিশূল পৃথকভাবে নির্মিত হয় এবং সেগুলি মূর্তির পাশে স্থাপিত হয়। কিন্তু যেহেতু এই ধরনের পৃথক বস্তুগুলির অনেকগুলিই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে, তাই অনেক ব্রোঞ্জ মূর্তিতে সেগুলি দেখা যায় না।[২৮] ভিক্ষাটনের সঙ্গে থাকেন নারী এবং ভূতগণ। তার অনুচরদের একজন ভিক্ষাটনের বাঁ পাশে থেকে ভিক্ষায় প্রাপ্ত খাদ্য সঞ্চয়ের জন্য একটি বৃহদাকার পাত্র বহন করেন। প্রায়শই দেখা যায়, তার অনুগামিনীদের সংখ্যা সাত।[৩৬] তাঁদের চিত্রণও ভিন্ন ভিন্নভাবে হয়ে থাকে। কোথাও তারা শিবকে দেখে বিমোহিত, তাঁকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক, তাঁকে আশীর্বাদ করছেন, আবার কোথাওবা হাতায় করে তার ভিক্ষাপাত্রে অন্নদান করছেন। এঁদের মধ্যে কারও কারও পরিধেয় বস্ত্র কোমর থেকে খসে পড়েছে, যা তাঁদের কামার্ততার প্রতীক।[২৮] যে নারী ভিক্ষাটনকে ভিক্ষা দান করেছিলেন, তাঁকে শস্যাধিষ্ঠাত্রী দেবী অন্নপূর্ণা হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়।[৩০] বিভিন্ন দেবতা, গন্ধর্ব ও ঋষিগণ করজোড় করে তার সামনে নত হন।[২৮] কোনও কোনও দৃশ্যে দেখা যায়, ক্রুদ্ধ ঋষিরা ভিক্ষাটনকে প্রহার করার চেষ্টা করছেন। এই দৃশ্যগুলি দারুকবনের কিংবদন্তিকে ইঙ্গিত করে।[৩০] ক্রমবিকাশ ও জনপ্রিয়তাভিক্ষুকবেশী শিবের ধারণাটি কেবলমাত্র ভিক্ষাটনের মূর্তি বা তার কিংবদন্তির সঙ্গেই সম্পৃক্ত নয়। অনেক স্থলেই উল্লিখিত হয়েছে শিব গৃহহীন ভিক্ষুক-সন্ন্যাসীর বেশে ব্রহ্মাণ্ড পর্যটন করছেন এবং তার শক্তি পার্বতী তাঁকে জাগতিক ও গৃহস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছেন।[৩৭] কোনও কোনও বর্ণনা অনুযায়ী, শিব পার্বতীর অন্নাধিষ্ঠাত্রী রূপ অন্নপূর্ণার কাছে ভিক্ষা প্রার্থনা করেন।[৩৮] শতরুদ্রীয় বিবরণ অনুযায়ী শিব ভিক্ষা করে অন্ন সংগ্রহ করেন। এই বর্ণনা তার ভিক্ষাটন রূপের স্মৃতি জাগরিত করে। তা সত্ত্বেও শিবকে বর্ণনা করা হয়েছে ব্রহ্মাণ্ডের ও জীবনদাতা অন্নের অন্যতম পালকরূপে।[৩৮] শিবকে সাধারণভাবে ভিক্ষুক হিসাবে বর্ণনা করা হলেও ভিক্ষাটন উপাখ্যানের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু অর্থাৎ পাপ স্খালনার্থে শিবের পর্যটনের কথার উৎস স্বতন্ত্রভাবে কাপালিকদের সন্ন্যাসপ্রথা এবং তার পূর্বসূরি পাশুপত সম্প্রদায়।[৯] ভিক্ষাটন হলেন কপালীদের ("করোটি-বাহক") ভূমিকারই প্রতিচ্ছবি। কপালীরা হলেন পরিব্রাজক সন্ন্যাসী, যাঁরা ত্রিশূল ও জাদুক্ষমতা দ্বারা নিজেদের রক্ষা করেন, কপালপাত্র বহন করেন এবং শিবের পূজা করেন (কপালি শব্দটিও কাপালিক সম্প্রদায়ের সদস্য বোঝাতে ব্যবহার করা হয়)। কূর্মপুরাণের মতো কোনও কোনও ধর্মগ্রন্থে প্রকাশ্যভাবেই শিবকে কপালী বলে উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, এই মূর্তিতে "একজন অপরিচিত ব্যক্তি তার রূপ দেখে ভয় পায়, এবং কখনও কখনও মোহিত হয়"।[৯][৩৯] কথিত আছে, ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তক ছেদনের পাপ স্খালনের জন্য শিব নিজের দেহ থেকে ভৈরবকে পৃথক করেন এবং ভৈরবের হস্তে ব্রহ্মার করোটিসহ তাঁকে প্রেরণ করেন পরিব্রাজনে। এই ব্রতটি অসাবধানতায় ব্রাহ্মণ হত্যার পাপ স্খালনের জন্য কপালিদের আবশ্যকর্তব্য "মহাব্রতের" অনুরূপ। পাপ স্খালনার্থে দ্বাদশবর্ষব্যাপী পরিব্রাজনের শাস্তি "ভ্রুণঘ্ন" পাপীদের অর্থাৎ, অপর এক জ্ঞানী ও সদাচারী ব্রাহ্মণকে হত্যাকারী ব্রাহ্মণকেও পালন করতে হয়। নীতি ও আচরণবিধি-সংক্রান্ত গ্রন্থ ধর্মশাস্ত্রে এই ব্রতের বিধান দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে পাপীকে নির্জন স্থানে বাস করতে হয় এবং নিহতের করোটি সহযোগে মাত্র সাতটি বাড়িতে ভিক্ষা করতে হয়। তাঁকে নিহতের অস্থিকে লাঠি হিসাবে ব্যবহার করতে হয়। সমাজে তাঁকে গণ্য করা হয় অস্পৃশ্য হিসাবে। একইভাবে ভিক্ষাটনের বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি ব্রহ্মার করোটি ভিক্ষাপাত্র এবং অস্থি লাঠি হিসাবে ব্যবহার করেন। তিনি ভ্রমণকালে সপ্তর্ষি নামে পরিচিত সাত মহর্ষির সাত গৃহে ভিক্ষা করেন এবং নগরীর বাইরে শ্মশানক্ষেত্রে বাস করেন।[৯][৪০][৪১] সমগ্র দক্ষিণ ভারতে শৈব মন্দিরগুলিতে ভিক্ষাটনের মূর্তি দেখা যায়।[২৭] কিন্তু উত্তর ভারতে এই রূপটি প্রায় অপরিচিত।[৪২] প্রত্যেকটি দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরের দেওয়ালে প্রস্তরনির্মিত ভিক্ষাটন মূর্তি শোভা পায়। ব্রোঞ্জনির্মিত মূর্তিগুলি উৎসবমূর্তি হিসাবে মন্দিরের শোভাযাত্রার সময় বের করা হয়।[২৯] দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরে ভিক্ষাটনের মূর্তি "আবরণ-দেবতা" (গর্ভ মন্দিরের প্রদক্ষিণ পথে স্থাপিত দেবতা) হিসাবে রাখার নিয়ম।[৪৩] একইভাবে ওড়িশার মন্দিরে ভিক্ষাটন মূর্তি পূজিত বা স্থাপিত হয় "পার্শ্ব-দেবতা" (সহচর দেবতা) বা "আবরণ-দেবতা" হিসাবে।[৩০] শিবের অপর রূপ নটরাজের মতো ভিক্ষাটনের মূর্তিতত্ত্ব ও পৌরাণিক কাহিনিটি দক্ষিণ ভারতে পূর্ণতর রূপ পেয়েছিল। উল্লেখ্য, ভিক্ষাটনের কিংবদন্তিও নটরাজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যদিও নটরাজের মতো ভিক্ষাটন নির্দিষ্ট কয়েকটি মন্দিরের সঙ্গে সম্পর্কিত নন। বরং প্রায় প্রত্যেকটি প্রধান তামিল মন্দিরের পৌরাণিক ও উৎসব-সংক্রান্ত প্রথার অঙ্গে পরিণত হন তিনি।[৪৪] উদাহরণস্বরূপ, চিদাম্বরমে (যেখানে একটি বিখ্যাত নটরাজ মন্দির অবস্থিত) ভিক্ষাটন মূর্তিকে মন্দিরের বার্ষিক উৎসবে একটি সোনার রথে চড়িয়ে শোভাযাত্রায় বের করা হয়।[৪৫] ময়লাপুর মন্দিরের উৎসবে ভিক্ষাটনের মূর্তিকে চার বেদের প্রতীক চারটি কুকুর ও গণ সহকারে শোভাযাত্রায় বের করা হয়। মন্দিরের কাহিনি অনুযায়ী, শিব তার পত্নী পার্বতীর (কর্পগম্বল) একটি আংটি হারিয়ে ফেলায় তিনি শিবকে ভিক্ষা করতে পাঠান। ভিক্ষাটনের প্রতি তার দুর্ব্যবহারে অনুতপ্ত এবং পথে ভিক্ষাটনের রূপে আকৃষ্ট নারীদের প্রতি ঈর্ষাবশত পার্বতী ভিক্ষাটনের পিছনে ছুটে যান এবং তার মন ফিরে পাওয়ার জন্য "নৃত্য" করতে থাকেন। শিব সদয় হন এবং তারা দুই জনে একসঙ্গে মন্দিরে ফিরে আসেন।[৪৬] তামিল সাহিত্যে শিবের করাল কপালী রূপটি রূপান্তরিত হয়ে অধিকতর মধুর একটি রূপে।[৪৭] দক্ষিণ ভারতীয় ভক্তিমূলক সাহিত্যে দারুকবনে ঋষিদের বাসস্থানে ভিক্ষাটনের আগমনের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নায়নার সন্ত-কবিদের তেবরম সাহিত্যে উল্লিখিত হয়েছে যে, গ্রাম্য নারীরাও তাঁকে অনুসরণ করেন এবং তাঁকে ডাকতে থাকেন। কোন কোন সন্ত-কবি ভিক্ষাটনের কামোদ্দীপক প্রকৃতি এবং তাঁকে ভিক্ষা দিতে আসা কামার্ত নারীদের হৃদয়াবেগ বর্ণনা করেছেন।[৩৯][৪৮] যদিও মণিক্কবচকারের সময়ে (খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দী) মাত্র তিনটি অথবা চারটি সূত্র থেকে শিবের ভিক্ষাবৃত্তির কথা জানা যায়।[৩৯] চম্পান্তর, অপ্পার ও কুন্টারারের কবিতাগুলির বিষয়বস্তু শিবের নটরাজ ও ভিক্ষাটন রূপ দু’টি।[৪৪] সপ্তম শতাব্দীর নায়নার সন্ত চম্পান্তর উল্লেখ করেন যে, ভিক্ষাটন দ্বারে দ্বারে ভিক্ষার জন্য ঘুরতে ঘুরতে ভিক্ষুকের ডাক দিতে থাকে, "নারীগণ, আমাকে ভিক্ষা দাও।" তিনি তার কবিতাগুলি লিখতেন ভিক্ষাটনের প্রতি কামার্ত নারীর জবানিতে। একটি কবিতায় চম্পান্তর আলংকারিক ভাষায় প্রশ্ন করছেন, শিব স্বয়ং সকল বস্তুর দাতা এবং ভক্তের সকল বিঘ্নের অপসারণকারী হয়েও কেন একটি ভয়াল সাদা করোটি হাতে নিয়ে ভিক্ষা করে ফিরছেন। অপর একটি কবিতায় এক নারীর জবানিতে তার অদ্ভুত রূপের কথা বলা হয়েছে। সেই নারী বলছেন, শিবের শরীরে সাপ জড়ানো দেখে তাঁকে ভিক্ষা দিতে যাওয়ার সময় তিনি কীরকম ভয় পেয়েছেন।[৪৯][৫০] সপ্তম শতাব্দীর অপর নায়নার কবি অপ্পার সুদর্শন ও বিবাহিতা নারীদের প্রলুব্ধকারী ভিক্ষুক শিবের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ভিক্ষাটনের বাক্যে ও দৃষ্টিতে নারীগণ আকৃষ্ট হন। তারা বলেন যে, সুদর্শন সেই ভিক্ষুক বাঘছাল পরে, সর্বাঙ্গে ছাই মেখে, হাতে কুঠার নিয়ে, একটি নরকরোটিকে ভিক্ষাপাত্র করে, একটি সাদা ষাঁড়ের পিঠে বসে আসেন। শিব ভিক্ষা চাইলেও নারীদের কাছ থেকে কোনও ভিক্ষাই গ্রহণ করলেন না সেগুলিকে "অতি সাধারণ" আখ্যা দিয়ে। যদিও তিনি নারীদের প্রবঞ্চনা ও ধূর্ততা থেকে সাবধান করে দিলেন।[৫১] অপ্পার তার অধিকাংশ কবিতায় অতিমাত্রায় আদিরসাত্মক উপাদান যুক্ত করতেন, যেখানে নারীগণ প্রত্যক্ষভাবে ভিক্ষাটনের শারীরিক স্পর্শ কামনা করছেন। অপ্পারের কবিতার এক নারী বলছেন:[৫২]
অষ্টম শতাব্দীর সন্ত কুন্টারার ভিক্ষাটনকে জটাধারী, সর্বাঙ্গে ভস্মচর্চিত, বল্কলপরিহিত এবং কটিতে বাঘছাল জড়িত মূর্তিতে বর্ণনা করেছেন। তিনি আরও বলেন যে, ভিক্ষাটন দিনের বেলা ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করেন এবং রাতে তার স্ত্রী ও একাধিক শৃগালসহ আগুনের সামনে নৃত্য করেন।[৫৩] আধুনিক যুগে কবি পাপনাশম শিবন (১৮৯০-১৯৭৩) ভিক্ষাটনের বর্ণনায় চারটি গান রচনা করেন। "পিচ্চাইক্কু বন্দিরো" গানে শিবন ভিক্ষুকবেশে শিবের পরিব্রাজনের কারণ অনুসন্ধান করেন। তার চিন্তায় ধরা পড়ে, হয়তো পার্বতী অলংকার চেয়েছেন বা তার পুত্র মোদক চেয়েছেন বলে অথবা তিনি যে ভিক্ষুক-সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করেও কতো সুন্দর তা জগৎকে দেখাতে বের হয়েছেন। "সৌন্দর্য বেল্লানটানিল" গানে এক কামার্ত নারীর জবানিতে মস্তক থেকে পদযুগল পর্যন্ত ভিক্ষাটনের সৌন্দর্য এবং তাঁকে পাবার জন্য সেই নারীর আকাঙ্ক্ষা বর্ণিত হয়েছে।[৪৬] তথ্যসূত্র
গ্রন্থপঞ্জি
|