আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস
আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস (ইংরেজি: Alfred Russel Wallace) (৮ই জানুয়ারি, ১৮২৩ - ৭ই নভেম্বর, ১৯১৩) ছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ, অভিযাত্রিক, ভূগোলবিদ, নৃবিজ্ঞানী, ও জীববিজ্ঞানী। তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত স্বাধীনভাবে "প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন" তত্ত্ব প্রণয়নের জন্য; এক্ষেত্রে তাকে চার্লস ডারউইনের সাথে যৌথভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ডারউইন ওয়ালেসের পূর্বেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন, কিন্তু গুটিকয় বন্ধু ছাড়া কাউকে জানাননি; ওয়ালেসের প্রকাশনার পর তিনি দ্রুত তার বিখ্যাত অন দি অরিজিন অফ স্পিসিস বই প্রকাশ করেন। ওয়ালেস বিশ্বের বেশ কিছু স্থানে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন; তার প্রথম গণ্তব্য ছিল আমাজন নদীর উপত্যকা। পরবর্তীতে যান মালয় দ্বীপপুঞ্জে, যেখানে তিনি এমন একটি বিভাজন রেখা আবিষ্কার করেন যা ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জকে দুই ভাগে ভাগ করে, এবং যার পূর্বের প্রাণীরা এশীয় ধরনের, আর পশ্চিমের প্রাণীরা অস্ট্রালেশীয় ধরনের। এই রেখাকে বর্তমানে ওয়ালেস রেখা বলা হয়। ঊনবিংশ শতকে প্রাণীদের ভৌগোলিক বণ্টন বিষয়ে তাকে সবচেয়ে বিজ্ঞদের একজন মনে করা হতো এবং অনেক সময় তাকে জীবভূগোলের জনক বলা হয়।[১] পাশাপাশি ঊনবিংশ শতকের শীর্ষ বিবর্তন বিষয়ক চিন্তাবিদ ও গবেষকদের মধ্যে তিনি অন্যতম। যৌথ কিন্তু স্বাধীনভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন আবিষ্কার ছাড়াও বিবর্তনীয় তত্ত্বের উন্নতিতে তার অনেক অবদান রয়েছে। যেমন, প্রাণীদের মধ্যে সতর্কীকরণ রঙের ধারণা, ওয়ালেস ক্রিয়া- প্রাকৃতিক নির্বাচন কীভাবে সংকরীকরণের বিরুদ্ধে বাঁধা তৈরির মাধ্যমে প্রজাতির উৎপত্তিতে ভূমিকা রাখতে পারে সে বিষয়ক একটি অণুকল্প। ওয়ালেস জীবনে অনেক প্রথাবিরুদ্ধ ধারণা সমর্থন করেছেন। আধ্যাত্মিকতার পৃষ্ঠপোষকতা এবং মানুষের সবচেয়ে উন্নত মানসিক দক্ষতাগুলোর অবস্তুগত উৎসে বিশ্বাস করায় সমকালীন বিজ্ঞানী সমাজের সাথে তার সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা দিয়েছিল। বৈজ্ঞানিক কাজের পাশাপাশি তিনি সমাজকর্মী হিসেবেও কাজ করেছেন, তিনি ঊনবিংশ শতকের ব্রিটিশ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তথা পুঁজিবাদের সমালোচনা করতেন। প্রকৃতির ইতিহাস বিষয়ে উৎসাহী হওয়ায় তিনি ছিলেন মানুষের দ্বারা পরিবেশের দূষণের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশকারী প্রথম বিজ্ঞানীদের একজন। ওয়ালেস একজন প্রসিদ্ধ লেখক, বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক দুই বিষয়েই তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া তে ভ্রমণ নিয়ে তার লেখা দ্য মালয় আর্কিপেলাগো সম্ভবত ঊনবিংশ শতকে প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক অভিযান বিষয়ক সেরা বই। জীবনের অধিকাংশ সময় জুড়েই ওয়ালেসের আর্থিক কষ্ট ছিল। আমাজন এবং দূরপ্রাচ্যে ভ্রমণের অর্থ তিনি জোগাড় করতেন মূলত বিভিন্ন দুর্লভ প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ ও বিক্রির মাধ্যমে। কিন্তু ব্যর্থ বিনিয়োগের কারণে এই ব্যবসার অধিকাংশ উপার্জনই তিনি হারাতে বাধ্য হন। এরপর তার আয়ের প্রায় একমাত্র উৎস ছিল লেখালেখি। সমকালীন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী সম্প্রদায়ের অন্য অনেকের (যেমন ডারউইন এবং চার্লস লায়েল) মত উত্তরাধিকার সূত্রে তার বিশাল সম্পত্তি ছিল না। এমনকি কোন দীর্ঘমেয়াদি আয়ের উৎসও তিনি খুঁজে পাননি। ১৮৮১ সালে ডারউইন তার জন্য একটি সামান্য সরকারি ভাতার ব্যবস্থা করে দেয়ার আগ পর্যন্ত তার কোন নিয়মিত আয় ছিল না। জীবনীপ্রারম্ভিক জীবনআলফ্রেড ওয়ালেস যুক্তরাজ্যের ওয়েল্স্-এ অবস্থিত মনমথশায়ার কাউন্টির আস্ক শহরের নিকটবর্তী ল্যানবাডক (Llanbadoc) নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[২] টমাস ওয়ালেস ও মেরি অ্যান গ্রিনেলের নয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সপ্তম। টমাস সম্ভবত স্কটিশ বংশোদ্ভূত। তার পরিবার, অন্য অনেক ওয়ালেস পরিবারের মতোই, ত্রয়োদশ শতকে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী উইলিয়াম ওয়ালেসের সাথে বংশীয় সম্পর্কের দাবী করে।[৩] টমাস আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করলেও কখনো আইন ব্যবসা করেননি; উত্তরাধিকারসূত্রে কিছু জমি পেয়েছিলেন যা থেকে আয়ও হতো, কিন্তু ব্যর্থ বিনিয়োগের কারণে তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা দিনদিন খারাপ হতে থাকে। তার মা হার্টফোর্ডশায়ারের (বর্তমান গ্রেটার লন্ডনের ঠিক উত্তরের কাউন্টি) কাউন্টি টাউন হার্টফোর্ডের এক মধ্যবিত্ত ইংরেজ পরিবার থেকে আসা।[৩] ওয়ালেসের পাঁচ বছর বয়সের সময় তাদের পরিবার হার্টফোর্ডে চলে যায়। তিনি হার্টফোর্ড গ্রামার স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন; কিন্তু পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণে ১৮৩৬ সালে স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।[৪] পরবর্তীতে ওয়ালেস লন্ডনে গিয়ে সাময়িকভাবে তার বড় ভাই জনের সাথে থাকা শুরু করেন। উনিশ বছর বয়সী জন তখন রাজমিস্ত্রীর কাজ শিখছিলেন। লন্ডনে থাকা অবস্থায় ওয়ালেস লন্ডন মেকানিক্স ইনস্টিটিউটে লেকচার শুনতেন এবং বই পড়তেন। এখানেই রেডিক্যাল রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও সমাজ সংস্কারক রবার্ট ওয়েন এবং টমাস পেইনের চিন্তাধারার সাথে তার পরিচয়। তবে তার লন্ডনের জীবন ক্ষণস্থায়ী ছিল, অচিরেই জ্যোষ্ঠ ভাই উইলিয়াম তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে চান। অগত্যা ১৮৩৭ সালে তিনি লন্ডন ত্যাগ করে উইলিয়ামের কাছে গিয়ে ভূমি জরিপের কাজ শেখা শুরু করেন; এই শিক্ষানবিশী কাজ তিনি ৬ বছর (১৮৩৭-৪৩) ধরে করেছেন। ১৮৩৯ সালের শেষদিকে দুই ভাই ওয়েলসের সীমান্তবর্তী এলাকা হেয়ারফোর্ডের কিংটনে কিছুদিনের জন্য বাস করেন এবং তৎপরবর্তীতে গ্ল্যামরগ্যান অঞ্চলের নিথ শহরে গিয়ে স্থায়ী হন। ১৮৪০ ও ১৮৪৩ সালের মধ্যে ওয়ালেস ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের পশ্চিমের গ্রামাঞ্চলে জমি জরিপের কাজ করেছেন।[৫][৬] ১৮৪৩ সালের শেষে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে উইলিয়ামের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ২০ বছর বয়সী ওয়ালেস সে বছরের জানুয়ারিতে ভাইকে ছেড়ে যান। জীবনের প্রথম দিকে অনেকবার স্থান বদলের কারণে ওয়ালেসের প্রকৃত জাতীয়তা নিয়ে আধুনিক যুগে কিছু বিতর্ক দেখা দিয়েছে। তার জন্ম যেহেতু মনমথশায়ারে সেহেতু কেউ কেউ তাকে ওয়েল্শ (ওয়েলসের মানুষ) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।[৭] কিন্তু অনেক ইতিহাসবিদ এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেন, কারণ- তার বাবা-মা'র কেউই ওয়েল্শ ছিলেন না, তাদের পরিবার খুব কম সময়ের জন্য মনমথশায়ারে বাস করেছে, ওয়ালেসের পরিচিত ওয়েল্শরা আসলে তাকে ইংরেজ হিসেবে চিনতো, এবং ওয়ালেস নিজেই বারংবার ওয়েলশের বদলে নিজেকে ইংরেজ হিসেবে পরিচয় দিছেন (এমনকি তার ওয়েলসে অবস্থানকালীন সময় নিয়ে লিখতে গিয়েও)। একজন ওয়ালেস বিশেষজ্ঞ এসব কারণের প্রেক্ষিতে তাকে ওয়েলসে জন্মগ্রহণকারী একজন ইংরেজ হিসেবে অভিহিত করেছেন।[৮] কিছুকাল বেকার থাকার পর ওয়ালেস লেস্টারের কলেজিয়েট স্কুলে চিত্রাঙ্কন, মানচিত্র নির্মাণ ও ভূমি জরিপের শিক্ষক হিসেবে একটি চাকরি পান। সেসময় তিনি লেস্টারের গণগ্রন্থাগারে অনেক সময় কাটাতেন। এখানেই টমাস ম্যালথাসের An Essay on the Principle of Population বইটি পড়েছেন এবং এক সন্ধ্যায় এই গ্রন্থাগারেই তার সাথে বিখ্যাত পতঙ্গবিদ হেনরি বেইটসের দেখা হয়েছিল। বেইটসের বয়স তখন ১৯ এবং এর আগে ১৮৪৩ সালে তিনি জুওলজিস্ট জার্নালে গুবরে পোকা নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। তিনি ওয়ালেসের বন্ধু হন এবং তার উৎসাহেই ওয়ালেস পোকামাকড় সংগ্রহ শুরু করেন।[৯][১০] ১৮৪৫ সালের মার্চে উইলিয়াম মারা যান, এবং ওয়ালেস তার শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভাইয়ের ব্যবসার দেখাশোনা করার জন্য নিথ ফিরে যান। কিন্তু তিনি ও ভাই জন একসাথে মিলেও ব্যবসাটি পুনরায় চালু করতে পারেননি। কয়েক মাস পর ওয়ালেস নিথ নদীর উপত্যকায় একটি রেললাইন নির্মাণের জরিপকাজে পুরঃপ্রকৌশলী হিসেবে চাকরি পান। এই জরিপের জন্য ওয়ালেসকে প্রচুর সময় গ্রামের বনাঞ্চলে কাটাতে হতো যা তার পোকা সংগ্রহের নতুন নেশাকে আরও উস্কে দেয়। এর মাঝে তিনি জনকে একটি নতুন স্থাপত্য ও পুরঃকৌশলের ব্যবসা শুরু করতে রাজি করান। তারা বেশ কয়েকটি প্রকল্পও সম্পন্ন করেছিলেন যার মধ্যে রয়েছে ১৮৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত নিথ মেকানিক্স ইনস্টিটিউটের ভবন নকশা।[১১] ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জিভন্স ওয়ালেসের কাজে মুগ্ধ হয়ে তাকে সেখানে বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের উপর কিছু লেকচার দিতে রাজি করিয়েছিলেন। ১৮৪৬ সালে ২৩ বছর বয়সী ওয়ালেস ভাই জনের সাথে মিলে নিথে একটি বাড়ি কিনতে সমর্থ হন যেখানে তারা মা এবং বোন ফ্যানির সাথে থাকতেন (বাবা ১৮৪৩ সালেই মারা গিয়েছিলেন)।[১২][১৩] এই সময় তিনি প্রচুর বই পড়েছেন এবং বন্ধু বেইটসকে রবার্ট চেম্বার্স-এর বেনামে প্রকাশিত বিবর্তন বিষয়ক বই Vestiges of the Natural History of Creation, চার্লস ডারউইনের দ্য ভয়েজ অফ দ্য বিগল এবং চার্লস লায়েলের প্রিন্সিপলস অফ জিওলজি বইগুলো নিয়ে চিঠি লিখেছেন।[১৪][১৫] অভিযাত্রা এবং প্রাকৃতিক বিশ্ব পর্যবেক্ষণআলেকজান্ডার হামবোল্ট, চার্লস ডারউইন এবং উইলিয়াম হেনরি এডওয়ার্ডসের মত বেশ কয়েকজন পর্যটক প্রকৃতিবিদদের দ্বারা উৎসাহিত হয়ে ওয়ালেস নিজেই প্রকৃতিবিদ হিসেবে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করার জন্য বিশ্বভ্রমণে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।[১৬] ১৮৪৮ সালে ওয়ালেস এবং হেনরি বেইটস ব্রাজিলের উদ্দেশ্যে মিসচিফ নামক একটি জাহাজে চেপে বসেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আমাজনের ঘনবর্ষণ বনভূমি থেকে পোকামাকড় এবং অন্যান্য প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করে এনে যুক্তরাজ্যের সংগ্রাহকদের কাছে বিক্রি করা। পাশাপাশি ওয়ালেস প্রাণীজগৎ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রজাতির ট্রান্সমিউটেশন ধারণার পক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করতে চেয়েছিলেন। প্রথম বছরের অধিকাংশ সময়ই ওয়ালেস ও বেইটস বেলেম দো পারা নামক স্থানের নিকটে তাদের সংগ্রহ অভিযান চালান, এরপর তারা আলাদা আলাদাভাবে সমুদ্র থেকে অপেক্ষাকৃত দূরের জায়াগাগুলোতে যেতেন এবং ফিরে এসে একে অপরকে তাদের নতুন আবিষ্কারগুলোর কথা বলতেন। ১৮৪৯ সালে তাদের সাথে স্বল্প সময়ের জন্য যোগ দিয়েছিলেন তরুণ অভিযাত্রী ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী রিচার্ড স্প্রুস এবং ওয়ালেসের ছোট ভাই হার্বার্ট। হার্বার্ট কিছুদিনের মধ্যেই ফিরে আসেন এবং দুই বছর পর পীতজ্বরে মারা যান। কিন্তু স্প্রুস বেইটসের মতোই আরও দশ বছর দক্ষিণ আমেরিকায় থেকে প্রচুর নমুনা সংগ্রহ করেন।[১৭] ওয়ালেস চার বছর ধরে রিও নেগ্রোর মানচিত্র তৈরির কাজ করেছেন, পাশাপাশি এর আশপাশে বসবাসকারী মানুষ, ভাষা, ভূগোল, উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং অনেক প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করেছেন।[১৮] ১৮৫২ সালের ১২ই জুলাই ওয়ালেস হেলেন নামক জাহাজে (পালতোলা, যাকে ব্রিগ বলা হয়) চড়ে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে ফিরতি যাত্রা করেন। ২৬ দিন জাহাজে থাকার পর হঠাৎ জাহাজটির মালামালে আগুন লেগে যায় এবং ক্রু-রা জাহাজ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ওয়ালেসের সংগৃহীত প্রাণীদের যে নমুনাগুলো জাহাজে ছিল তার সবই তাকে হারাতে হয়। জাহাজে ওঠার আগের কিছু সময়ে সংগৃহীত নমুনাগুলোই মূলত সেখানে ছিল, কিন্তু এগুলোই সম্ভবত তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নমুনা ছিল। তিনি কেবল তার ডায়রির কিছু অংশ এবং কিছু ছবি রক্ষা করতে পেরেছিলেন। দশ দিন উন্মুক্ত নৌকায় সমুদ্রে ভেসে ভেসে থাকার পর কিউবা থেকে লন্ডনগামী জর্ডেসন নামক একটি ব্রিগ তাদেরকে উদ্ধার করে। অনাকাঙ্ক্ষিত নতুন যাত্রীদের কারণে জর্ডেসনের মজুদকৃত খাবার ও অন্যান্য সুবিধাদি বেশ দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছিল। খুব কম রেশন নিয়ে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ একটি যাত্রা শেষে জাহাজটি অবশেষে ১৮৫২ সালের ১লা অক্টোবর ইংল্যান্ডে পৌঁছায়।[১৯][২০] যুক্তরাজ্যে ফেরার পর ওয়ালেস প্রায় ১৮ মাস লন্ডনে থাকেন জাহাজের আগুনে তার হারিয়ে যাওয়া সম্পদের ইন্স্যুরেন্সের অর্থে। অবশ্য রিও নেগ্রোর মানচিত্রে নির্মাণের আগে তিনি ব্রাজিল থেকে যে নমুনাগুলো ইংল্যান্ড পাঠিয়েছিলেন তার কিছুও এবার বিক্রি করতে সমর্থ হন। দক্ষিণ আমেরিকায় তার রোমাঞ্চকর অভিযানের প্রায় সকল রেকর্ড হারিয়ে যাওয়ার পরও এই সময়ের মধ্যে তিনি ছয়টি একাডেমিক গবেষণাপত্র (যার মধ্যে একটির নাম "On the Monkeys of the Amazon"), এবং দুইটি বই (Palm Trees of the Amazon and Their Uses এবং Travels on the Amazon) প্রকাশ করেন।[২১] He also made connections with a number of other British naturalists—most significantly, Darwin.[২০][২২][২৩] ১৮৫৪ থেকে ১৮৬২ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৩১ থেকে ৩৯ বছর বয়সের মাঝে ওয়ালেস পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ তথা মালয় আর্কিপেলাগোতে ছিলেন। বর্তমানে এই অঞ্চলটি সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার অন্তর্ভুক্ত। এবারও তার উদ্দেশ্য ছিল নমুনা সংগ্রহ এবং প্রাকৃতিক ইতিহাসের নিবিঢ় অধ্যয়ন। ইন্দোনেশিয়াতে তার সংগ্রহীকৃত ৮০টি পাখি প্রজাতির কঙ্কাল এবং তৎসংশ্লিষ্ট তথ্যাদি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।[২৪] তিনি লক্ষ্য করেছিলেন মালয় দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিমাঞ্চলের জীবজন্তু এশীয় প্রকৃতির কিন্তু পূর্বাঞ্চলের গুলো অস্ট্রালেশীয় প্রকৃতির। প্রজাতির উৎপত্তি নিয়ে গবেষণার অংশ হিসেবে এসব প্রাণী গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ এবং সমুদ্রের পানির গভীরতা পরিমাপ করে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই দ্বীপপুঞ্জের পূর্বাংশ (নিউ গিনি) এক সময় অস্ট্রেলিয়ার সাথে যুক্ত ছিল, এবং সেটি যেহেতু কখনো পশ্চিমাংসের সাথে ভূমি দিয়ে যুক্ত হয়নি, সেহেতু সেখানকার জীবজন্তু আলাদাই রয়ে গেছে। বর্তমানে পূর্ব-পশ্চিমকে বিভাজনকারী এই রেখাকে ওয়ালেস রেখা বলা হয়। ওয়ালেস মালয় দ্বীপপুঞ্জে ১২৬,০০০ এরও বেশি নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন যার মধ্যে কেবল গুবরে পোকাই ছিল ৮০ হাজার। এর মধ্যে কয়েক হাজার ছিল তখনকার বিজ্ঞানীদের কাছে অজানা প্রজাতি।[২৫] এই অঞ্চলে তার আবিষ্কার করা সবচেয়ে পরিচিত প্রজাতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উড়তে সক্ষম ব্যাঙ Rhacophorus nigropalmatus যাকে বর্তমানে ওয়ালেসের উড়ুক্কু ব্যাঙ বলা হয়। এখানে থাকার সময়ই তিনি বিবর্তন সম্পর্কে তার ধারণাগুলো আরও পরিষ্কার করেন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়াটি আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। ১৮৫৮ সালে নিজের তত্ত্বটি একটি চিঠির মাধ্যমে তিনি ডারউইনের কাছে পাঠান। সে বছরই এই চিঠির বিষয়বস্তু এবং ডারউইনের নিজের বিবর্তন বিষয়ক তত্ত্ব একসাথে প্রকাশিত হয়। তার পূর্ব এশীয় অভিযানের বিস্তারিত বর্ণনা অবশেষে ১৮৬৯ সালে The Malay Archipelago নামক একটি বই হিসেবে প্রকাশিত হয়। এটি ঊনবিংশ শতকের বৈজ্ঞানিক অভিযান বিষয়ক সবচেয়ে জনপ্রিয় বই এবং প্রথম প্রকাশের পর থেকে এ পর্যন্ত তা নিরবচ্ছিন্নভাবে মুদ্রিত হয়ে চলেছে। বইটি তিনি ডারউইনকে উৎসর্গ করেছিলেন এবং ডারউইন বইটির অনেক প্রশংসাও করেন। এছাড়া চার্লস লায়েল এবং বিখ্যাত ঔপন্যাসিক জোসেফ কনরাড বইটির প্রশংসা করেন। কনরাড দ্য মালয় আর্কিপেলাগো-কে তার প্রিয় "bedside companion" হিসেবে অভিহিত করেছিলেন এবং তার বেশ কয়েকটি উপন্যাসের (বিশেষ করে Lord Jim) তথ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।[২৬] ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তন, বিয়ে ও সন্তান১৮৬২ সালে ওয়ালেস ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে তার বোন ফ্যানি সিমস ও বোনের স্বামী টমাসের সাথে বসবাস শুরু করেন। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি এসময় তিনি তার অসংখ্য সংগ্রহ গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন এবং জুওলজিক্যাল সোসাইটি অফ লন্ডনের মত অনেক বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানে তার অভিযান এবং আবিষ্কারগুলো নিয়ে বক্তৃতা দেন। সে বছরের পরের দিকে তিনি ডাউন হাউজে ডারউইনের সাথে দেখা করতে যান এবং চার্লস লায়েল ও হার্বার্ট স্পেন্সারের সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।[২৭] ১৮৬০-এর দশকে ওয়ালেস প্রাকৃতিক নির্বাচনকে সমর্থন করে বেশ কিছু গবেষণাপত্র লিখেন এবং লেকচার প্রদান করেন। অনেকগুলো বিষয় নিয়ে ডারউইনের সাথেও তার আলোচনা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় হয়, যেমন, যৌন নির্বাচন, সতর্কীকরণ বর্ণ, এবং সংকরীকরণ ও প্রজাতির বিভাজনে প্রাকৃতিক নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রভাব।[২৮] ১৮৬৫ সালে তিনি আধ্যাত্ম্যবাদ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন।[২৯] এক বছর সম্পর্কের পর ওয়ালেসের সাথে ১৮৬৪ সালে এক তরুণীর বাগ্দান সম্পন্ন হয়। তরুণীকে নিজের আত্মজীবনীতে তিনি শুধু মিস এল হাওএভার নামে সম্বোধন করেছেন। মেয়েটি বিয়ে ভেঙে দেয়ায় ওয়ালেস বেশ দুঃখ পেয়েছিলেন।[৩০] ১৮৬৬ সালে ওয়ালেস অ্যানি মিটেনকে বিয়ে করেন। মিটেনের সাথে তার পরিচয় হয়েছিল বন্ধু রিচার্ড স্প্রুসের মাধ্যমে; আমরা ইতোমধ্যে জানি স্প্রুসের সাথে তিনি ব্রাজিলে অনেকদিন ছিলেন, এছাড়া স্প্রুস মিটেনের বাবা সুপরিচিত মস বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম মিটেনের একজন ভাল বন্ধু ছিলেন। ১৮৭২ সালে ওয়ালেস এসেক্সের নিকটবর্তী গ্রেস শহরে লিজ নেয়া একটি জমিতে দ্য ডেল নামক বাড়িটি নির্মাণ করেন যেখানে ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত ছিলেন। ওয়ালেসদের তিনটি সন্তান হয়েছিল: হার্বার্ট (১৮৬৭-৭৪), ভায়োলেট (১৮৬৯-১৯৪৫), এবং উইলিয়াম (১৮৭১-১৯৫১)।[৩১] আর্থিক দুর্দশা১৮৬০ ও ১৮৭০ এর দশকে ওয়ালেস তার পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন। মালয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে প্রচুর প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন এবং তার এজেন্ট সেগুলো বেশ সতর্কতার সাথেই বিনিয়োগ করেছিলেন। এসব নমুনা থেকে তার যথেষ্ট উপার্জন হয়। কিন্তু ইংল্যান্ড ফিরে আসার পর তিনি রেলপথ ও খনির কাজে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেন যার প্রায় পুরোটাই বিফলে যায়। এর ফলে জীবন ধারণের জন্য তাকে তার বিখ্যাত দ্য মালয় আর্কিপেলাগো বইয়ের বিক্রির উপর নির্ভর করতে হয়।[৩২] বন্ধুদের সহায়তা সত্ত্বেও তিনি কখনও একটি স্থায়ী বেতনভুক্ত চাকরি (যেমন কোন জাদুঘরের কিউরেটর) জোগাড় করতে পারেননি। আর্থিক সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি সরকারী পরীক্ষার খাতা দেখা শুরু করেন, এবং ১৮৭২ থেকে ১৮৭৬ এর মধ্যে প্রায় ২৫টি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র লিখেন। পাশাপাশি লায়েল ও ডারউইনের কিছু লেখা সম্পাদনা করে দেয়ার জন্যও তিনি অর্থ পেতেন।[৩৩] ১৮৭৬ সালে ওয়ালেস আরেক উভয় সংকটে পড়েন- হয় তাকে The Geographical Distribution of Animals বইয়ের প্রকাশকদেরকে ৫০০ পাউন্ড দিতে হবে, অন্যথায় নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিক্রি করতে হবে।[৩৪] ডারউইন তার এসব দুর্দশা সম্পর্খে জানতেন এবং বিজ্ঞানের কাজে তার অসংখ্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে একটি নিয়মিত সরকারি ভাতার ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য লবিং করেন। অবশেষে ১৮৮১ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে বাৎসরিক ২০০ পাউন্ড ভাতা দেয়া শুরু করে। লেখালেখির পাশাপাশি এই ভাতা পাওয়ার কারণে তার আর্থিক অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছিল।[৩৫] সমাজকর্মী ওয়ালেসদ্য মালয় আর্কিপেলাগো বইয়ে ওয়ালেসের করা ইংরেজ সমাজের সমালোচনা পড়ে জন স্টুয়ার্ট মিল মুগ্ধ হয়েছিলেন। মিল তাকে তার প্রতিষ্ঠিত "ল্যান্ড টেনিউর অ্যাসোসিয়েশন"-এ যোগ দেয়ার আহ্বান জানান, অবশ্য ১৮৭৩ সালে মিলের মৃত্যুর সংগঠনটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৮৭৩ থেকে ১৮৭৯ সালের মধ্যে তিনি সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ে মাত্র গুটিকয়েক প্রবন্ধ লিখেছিলেন এবং ৫৬ বছর বয়সে ব্যবসায়িক নীতি এবং ভূমি আইনের সংশোধন বিষয়ক বিতর্কে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তিনি মনে করতেন গ্রামের জমির মালিকানা সরকারের হাতে থাকা উচিত এবং সরকারের পক্ষ থেকে সে জমিকে এমন সব মানুষের মধ্যে বণ্টন করা উচিত যাতে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের উপকার হয় এবং ব্রিটিশ সমাজের প্রথাগত ধনকুবের ভূমি মালিকদের রাজত্বের অবসান ঘটে। ১৮৮১ সালে নবপ্রতিষ্ঠিত ল্যান্ড ন্যাশনালাইজেশন সোসাইটির প্রথম সভাপতি হিসেবে ওয়ালেসকে মনোনীত করা হয়। পরবর্তী বছর তিনি ভূমির জাতীয়করণ নিয়ে Land Nationalisation; Its Necessity and Its Aims নামে একটি বই প্রকাশ করেন। যুক্তরাজ্যের "মুক্ত অর্থনীতি" নীতির সমালোচনা করেন কারণ তার তা শ্রমিক শ্রেণীর জন্য ক্ষতিকর।[২৩][৩৬] ১৮৮৯ সালে ওয়ালেস এডওয়ার্ড বেলামির লেখা লুকিং ব্যাকওয়ার্ড বইটি পড়ার পর নিজেকে সমাজতন্ত্রী (সোশ্যালিস্ট) ঘোষণা করেন।[৩৭] এই আদর্শের প্রতি বিশ্বাসের কারণেই তিনি ইউজেনিক্সের বিরোধিতা করেন, যা ঊনবিংশ শতকের অন্য অনেক বিখ্যাত বিবর্তনবাদীর সমর্থন লাভ করেছিল। অনেক বিবর্তনীয় চিন্তাবিদ মনে করতেন, সমসাময়িক সমাজ এতো দুর্নীতিগ্রস্ত ও অনৈতিক যে বিবর্তনীয় দৃষ্টিতে কে যোগ্য আর কে অযোগ্য তা নির্ধারণ করা অসম্ভব। এই যুক্তিতেই তারা ইউজেনিক্স সমর্থন করেছিলেন।[৩৮] ১৮৯০ এর প্রবন্ধ "Human Selection" ওয়ালেস লিখেছিলেন, "সম্পদের প্রতিযোগিতায় যারা বিজয়ী হয় তারা কোনভাবেই সর্বোত্তম বা সবচেয়ে বুদ্ধিমান নয়..."[৩৯] ১৮৯৮ সালে তিনি কেবলমাত্র কাগজের উপর ভিত্তি করে একটি মুদ্রা ব্যবস্থা (যা কোন স্বর্ণ বা রৌপ্যের উপর নির্ভরশীল হবে না) প্রণয়নের পক্ষে একটি গবেষণাপত্র লেখেন। এই প্রবন্ধ অর্থনীতিবিদ আরভিং ফিশারকে এতোই মুগ্ধ করেছিল যে তিনি তার ১৯২০ সালের বই Stabilizing the Dollar ওয়ালেসকে উৎসর্গ করেন।[৪০] এছাড়া অন্য অনেক রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে ওয়ালেস লিখেছেন, যেমন নারীদের ভোগান্তি, এবং সামরিকয়ানের ঝুঁকি ও অপচয়।[৪১][৪২] ১৮৯৯ সালে তিনি The Wonderful Century: Its Successes and Its Failures নামে একটি বই লিখেন যার বিষয়বস্তু ছিল ঊনবিংশ শতকের প্রেক্ষিতে উন্নয়ন। বইটির প্রথম অংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বর্ণনা করে; দ্বিতীয় অংশের উদ্দেশ্য ছিল এসব উন্নয়নের সামাজিক ব্যর্থতা তুলে ধরা, যেমন, যুদ্ধ ও সামরিক ক্ষমতার লড়াইয়ে ধ্বংসযজ্ঞ এবং অপচয়, নগরবাসী দরিদ্র সমাজের উদ্ভব যারা ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস ও কাজ করে, একটি নিষ্ঠুর বিচার ব্যবস্থা যা অপরাধীদেরকে সংশোধন করতে পুরোপুরি ব্যর্থ, ব্যক্তিগত মালিকানায় পরিচালিত স্যানাটোরিয়ামে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার অপব্যবহার, পুঁজিবাদের কারণে পরিবেশ বিপর্যয় এবং ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের কালো রূপ।[৪৩][৪৪] বাকি জীবন তিনি সমাজিক আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। মৃত্যুর মাত্র কয়েক সপ্তাহ পূর্বে The Revolt of Democracy নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন।[৪৫] সামাজিক কাজের পাশাপাশি ওয়ালেস তার বৈজ্ঞানিক কাজও চালিয়ে গেছেন। ১৮৮০ সালে The Geographic Distribution of Animals এর পরের পর্ব হিসেবে Island Life বইটি প্রকাশ করেন। ১৮৮৬ সালের নভেম্বরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১০ মাসের সফরে যান বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা প্রদানের উদ্দেশ্য। অধিকাংশ লেকচারের বিষয়বস্তু ছিল ডারউইনবাদ অর্থাৎ প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন। তবে এর পাশাপাশি জৈব-ভূগোল, আধ্যাত্মিকতা এবং সমাজ-রাজনৈতিক সংস্কার নিয়েও বক্তৃতা দেন। এই সফরের সময় তার ভাই জনের সাথে দেখা করেন যিনি আগের বছর ক্যালিফোর্নিয়ায় অভিবাসী হিসেবে চলে গিয়েছিলেন। তিনি কলোরাডোতেও এক সপ্তাহ থাকেন, এবং সেখানে মার্কিন উদ্ভিদবিজ্ঞানী অ্যালিস ইস্টউডকে গাইড হিসেবে নিয়ে রকি পর্বতমালার উদ্ভিদ প্রজাতিগুলো পর্যবেক্ষণ করেন। রকি পর্বতমালা থেকে সংগৃহীত তথ্যের মাধ্যমে একটি নতুন তত্ত্ব প্রণয়ন করেছিলেন যা বলে, ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আমেরিকার পাহাড়গুলোর মধ্যে বিশেষ কিছু সাদৃশ্যকে হিমবাহের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। ১৮৯১ সালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র "English and American Flowers"-এ তত্ত্বটি প্রকাশ করেছিলেন। ওয়ালেস আরও অনেক বিখ্যাত মার্কিন প্রকৃতিবিদের সাথে দেখা করেন এবং তাদের সংগ্রহ দেখেন। তার ১৮৮৯ সালের বই, ডারউইনিজম লেখার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সংগৃহীত এসব তথ্য এবং সেখানে লেকচার দেয়ার জন্য তার প্রস্তুতি কাজে লেগেছিল।[৪৬][৪৭] ওয়ালেস উদ্ভিদ ও প্রাণীর একটি বিশাল সংগ্রহ নিয়মতান্ত্রিকভাবে সাজিয়েছিলেন যেগুলো কিছু "কেবিনেট"-এ রাখা হতো। এর মধ্যে কেবল একটি সংগ্রহই এখনও তার মূল কেবিনেটে আছে। এতে মোট নমুনার সংখ্যা ১৭০০ যার মাঝে রয়েছে বিভিন্ন প্রকারের পোকামাকড় যেমন, প্রজাপতি, গুবরে পোকা, মথ, শেল, মাছি, মৌমাছি, প্রেয়িং ম্যান্টিস, টারান্টুলা, সিপড, একটি হর্নেটের ঘর, এবং একটি ছোট পাখি। রবার্ট হেগেস্টাড নামক একজন সংগ্রাহক ১৯৭৯ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে এই কেবিনেটের সন্ধান পান এবং ৬০০ ডলার দিয়ে কিনে নেন যদিও তখন তিনি জানতেন কেবিনেটটি কার হাতে সাজানো। পরবর্তীতে তিনি ওয়ালেসের লেখা থেকে তথ্য নিয়ে এই কেবিনেটের নমুনাগুলোর বর্ণনা লিপিবদ্ধ করতে শুরু করেন এবং ৬২ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন তৈরি শেষে প্রমাণ করতে সমর্থ হন কেবিনেটটি ওয়ালেসের নিজের হাতেই নির্মীত। তিনি গ্রাফোলজি-বিদ বেভারলি ইস্টকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন কেবিনেটের হাতের লেখাগুলো কার তা অণুসন্ধান করার জন্য। এটিই ওয়ালেসের নিজের হাতে তৈরি একমাত্র পুরোপুরি সংরক্ষিত কেবিনেট। বর্তমানে ধারণা করা হয়, ওয়ালেস রোজউড কেবিনেটটির জন্য নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন বিজ্ঞানীদেরকে কিছু বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য।[৪৮][৪৯] মৃত্যু১৯১৩ সালের ৭ই নভেম্বর ওয়ালেম গ্রামে নিজের বাড়িতে (ওল্ড অর্চার্ড নামের বাড়িটি এক দশক আগে তিনি নিজেই নির্মাণ করেছিলেন) মৃত্যুবরণ করেন।[৫০] মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। সংবাদপত্রে তার মৃত্যুর খবর ফলাও করে ছাপা হয়। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস তাকে বলে, "the last of the giants belonging to that wonderful group of intellectuals that included, among others, Darwin, Huxley, Spencer, Lyell, and Owen, whose daring investigations revolutionised and evolutionised the thought of the century." (বঙ্গানুবাদ: এই শতাব্দীর চিন্তাধারাকে বুদ্ধিজীবীদের যে অনন্যসাধারণ গোষ্ঠীটি বিপ্লব ও বিবর্তনে প্লাবিত করেছেন, যে গোষ্ঠীতে অন্যদের মাঝে ছিলেন ডারউইন, হাক্সলি, স্পেন্সার, লায়েল এবং ওয়েন, সেই গোষ্ঠীর শেষ মহামানব) একই পত্রিকার একই সংখ্যায় আরেকজন লিখেন, "No apology need to be made for the few literary or scientific follies of the author of that great book on the 'Malay Archipelago'." (বঙ্গানুবাদ: মালয় দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে লেখা সেই চমৎকার বইটির লেখকের কিছু সাহিত্যিক ও বৈজ্ঞানিক ত্রুটির জন্য কোন ক্ষমা প্রার্থনার প্রয়োজন নেই।)[৫১] ওয়ালেসের কিছু বন্ধু চেয়েছিলেন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে তাকে সমাধিস্থ করা হোক। কিন্তু তার স্ত্রী ওয়ালেসের ইচ্ছা অনুসারেই ডর্সেটের ব্রডস্টোনে অবস্থিত ছোট্ট গোরস্থানটিতে তার সমাধি দেন।[৫০] বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে যেখানে ডারউইনের সমাধি রয়েছে তার পাশে ওয়ালেসের অন্তত একটি পদক রাখার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। তাদের চেষ্টায় অবশেষে ১৯১৫ সালের ১লা নভেম্বর পদকটি উন্মোচন করা হয়। বিবর্তন তত্ত্ববিবর্তন বিষয়ে প্রাথমিক চিন্তাওয়ালেস তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন পর্যটক প্রকৃতিবিদ হিসেবে এবং শুরুতেই তিনি প্রজাতির ট্রান্সমিউটেশনে বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন যেটা ডারউইন কখনো করেননি। জঁ-বাতিস্ত লামার্ক, এতিয়েন জফ্রোয়া সাঁ-হিলের, ইরাসমাস ডারউইন এবং রবার্ট গ্র্যান্টের মত কিছু বিজ্ঞানী এই ধারণার গোড়াপত্তন ঘটিয়েছিলেন। ধারণাটি নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও সে সময়কার সবচেয়ে বিখ্যাত প্রকৃতিবিদরা এটি গ্রহণ করেননি, এবং এর মধ্যে অনেক রেডিক্যাল ও বৈপ্লবিক উপাদান আছে বলে মনে করা হতো।[৫২][৫৩] বিখ্যাত অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ্যা বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ জর্জ কুভিয়ের, রিচার্ড ওয়েন, অ্যাডাম সেজউইক এবং চার্লস লায়েল ট্রান্সমিউটেশনের ধারণার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন।[৫৪][৫৫] অনেক সময় বলা হয়, ওয়ালেস ধারণাটি গ্রহণ করেছিলেন কারণ রাজনীতি, ধর্ম ও বিজ্ঞান সকল ক্ষেত্রেই সবচেয়ে রেডিক্যাল ধারণাগুলোর প্রতি তার দুর্বলতা ছিল।[৫৬] ওয়ালেস রবার্ট চেম্বারসের ভেস্টিজেস অফ দ্য নেচারাল হিস্টরি অফ ক্রিয়েশন বইয়ের দ্বারাও গভীরভাবে প্রভাবিত হন। ১৮৪৪ সালে বেনামে প্রকাশিত এই জনপ্রিয় বিজ্ঞান গ্রন্থটিও অনেক বিতর্ক ও সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। এতে আমাদের পুরো সৌরজগৎ, পৃথিবী এবং এতে বসবাসকারী সকল জীবের একটি বিবর্তনীয় উৎস আছে বলে প্রস্তাব করা হয়েছিল।[৫৭] ওয়ালেস ১৮৪৫ সালে হেনরি বেইটসকে লিখেন,
১৮৪৭ সালে আবারও বেইটসকেই লিখেন,
ওয়ালেস ইচ্ছাকৃতভাবে তার কিছু মাঠ পর্যায়ের কাজ এমনভাবে নকশা করেছিলেন যাতে পরীক্ষা করা যায়, একটি বিবর্তনীয় দৃশ্যপটে খুব কাছাঁকাছি প্রজাতিগুলো পরস্পরের কাছাঁকাছি তথা প্রতিবেশে বসবাস করে কি না।[৫২] আমাজন নদীর অববাহিকায় থাকার সময় তিনি বুঝতে পারেন, ভৌগোলিক বাঁধা (যেমন আমাজন নদী ও তার শাখা-প্রশাখা) কাছাঁকাছি সম্পর্কের কিছু প্রজাতিকে ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। ১৮৫৩ সালের গবেষণাপত্র "On the Monkeys of the Amazon"-এ বিষয়টি নিয়ে লিখেছিলেনও।[৫৯] প্রবন্ধটির শেষদিকে তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করেন, "খুব কাছাঁকাছি সম্পর্কের প্রজাতিগুলো কি কখনও একটি বিশাল বাঁধার মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়?" ১৮৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বোর্নিও দ্বীপের সারাওয়াকে কাজ করার সময় তিনি "On the Law which has Regulated the Introduction of New Species" নামে একটি গবেষণাপত্র লিখেন যা অ্যানালস অ্যান্ড ম্যাগাজিন অফ নেচারাল হিস্টরি তে ১৮৫৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়।[৬০] এই গবেষণাপত্র তিনি জীবিত এবং জীবাশ্ম প্রজাতিদের ভৌগোলিক এবং ভূতাত্ত্বিক বণ্টন নিয়ে আলোচনা করেন যা পরবর্তীতে জৈব-ভূগোল নামে বিজ্ঞানের একটি আলাদা শাখার জন্ম দেয়। তার উপসংহার "Every species has come into existence coincident both in space and time with a closely allied species" পরবর্তীতে সারাওয়াক নীতি হিসেবে পরিচিত হয়। এভাবে আমাজন অববাহিকার বানরদের নিয়ে তিনি যে প্রশ্ন রেখেছিলেন নিজেই তার উত্তর দিতে সক্ষম হন। এই গবেষণাপত্রে বিবর্তন কীভাবে ঘটে তার কোন স্পষ্ট রূপরেখা না থাকলেও একে তিন বছর পর লেখা তার যুগান্তকারী গবেষণাপত্রটির ভূমিকা হিসেবে উল্লেখ করা যায়।[৬১] এই গবেষণাপত্র চার্লস লায়েলের বিশ্বাসকে (প্রজাতি অপরিবর্তিত থাকে) নড়বড়ে করে দিয়েছিল। তার বন্ধু চার্লস ডারউইন ১৮৪২ সালে তাকে লেখা একটি চিঠিতে প্রজাতির ট্রান্সমিউটেশনের পক্ষে কিছু প্রমাণ দিলেও লায়েল সবসময় তার বিরোধিতা করে গেছেন। ১৮৫৬ সালের শুরুর দিকে তিনি ডারউইনকে ওয়ালেসের গবেষণাপত্রটির কথা জানান, পাশাপাশি এডওয়ার্ড ব্লিথও জানান যিনি মন্তব্য করেছিলেন, "Good! Upon the whole!... Wallace has, I think put the matter well; and according to his theory the various domestic races of animals have been fairly developed into species." ব্লিথের এই সোজাসাপ্টা ইঙ্গিত সত্ত্বেও ডারউইন ওয়ালেসকে ভুল বুঝেন এবং গবেষণাপত্রটির প্রস্তাবনাকে তখন বেশ সুপরিচিত progressive creationism ধারণার সমার্থক বলে ভেবে নেন। তিনি ওয়ালেসকে গবেষণাপত্রটির প্রতি ইঙ্গিত করে লিখেন, "nothing very new ... Uses my simile of tree [but] it seems all creation with him." অবশ্য লায়েল ওয়ালেসের লেখার প্রতি অপেক্ষাকৃত বেশি আকৃষ্ট হন এবং একটি নোটবই খুলে তাতে এই অণুকল্পের ফলাফল কি হতে পারে (বিশেষ করে মানুষের পূর্বপুরুষদের জন্য) তার হিসাব মেলানোর চেষ্টা করতে থাকেন। ডারউইন এর আগেই তার তত্ত্বটি তাদের পারষ্পরিক বন্ধু জোসেফ হুকার কে দেখিয়েছিলেন এবং তখন লায়েলের কাছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের পুরো ব্যাপারটি পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেন। লায়েল তার সাথে একমত না হলেও এগিয়ে থাকার জন্য তাকে দ্রুত প্রবন্ধ প্রকাশ করতে বলেন। ডারউইন প্রথমে সংকোচ বোধ করলেও ১৮৫৬ সালের মে মাসে তার চলতি কাজগুলোর উপর ভিত্তি করে একটি species sketch লেখা শুরু করেন।[৬২] প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং ডারউইন১৮৫৮ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে ওয়ালেস মালয় দ্বীপপুঞ্জে তার জীবভূগোল সংশ্লিষ্ট কাজের মাধ্যমে বিবর্তনের বাস্তবতা বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে যান। পরবর্তীতে নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন,
তার আত্মজীবনী অনুসারে, জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে থাকার সময় তিনি হঠাৎ টমাস ম্যালথাসের জনসংখ্যা বিষয়ক তত্ত্বের (জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঠেকাতে প্রকৃতির কারসাজি) কথা চিন্তা করেন এবং তখনই প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণাটি তার মাথায় আসে।[৬৪] আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন সে সময় তিনি মালুকু দ্বীপপুঞ্জের টার্নাটি (Ternate) দ্বীপে ছিলেন, কিন্তু ইতিহাসবিদরা এই তথ্যটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, ওয়ালেসের নিজের দৈনন্দিন নোটবই অনুসারেই তার সে সময় হালমাহেরা (Gilolo নামেও পরিচিত) দ্বীপে থাকার কথা।[৬৫] ১৮৫৮ থেকে ১৮৬১ সালের মধ্যে তিনি টার্নাটি দ্বীপে ওলন্দাজ ব্যক্তা এম ডে ভান রেনেসে ভান ডাউভেনবোডে-র বাড়িতে ভাড়া থেকেছেন। আশপাশের কিছু দ্বীপে (যেমন হালমাহেরা) অভিযান চালানোর জন্য এই বাড়িটিকেই স্থায়ী ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করতেন।[৬৬] প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব কীভাবে আবিষ্কার করেছিলেন সে সম্পর্কে ওয়ালেসের নিজের ভাষ্য এরকম,
এর আগে ওয়ালেস একবার খুব কম সময়ের জন্য ডারউইনের সাথে দেখা করেছিলেন। ডারউইন তার অনেক ধারণার পক্ষে প্রমাণ হিসেবে ওয়ালেসের পর্যবেক্ষণের উদাহরণ দিয়েছেন। ডারউইনের প্রতি ওয়ালেসের প্রথম চিঠি হারিয়ে গেলেও ওয়ালেস যেসব চিঠি পেতেন তার সবই যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করে রাখতেন।[৬৮] প্রথম চিঠির তারিখ ১৮৫৭ সালের ১লা মে, যাতে ডারউইন লিখেছেন, ওয়ালেসের ১০ই অক্টোবরের চিঠি যা তিনি সম্প্রতি পেয়েছেন, এবং তার ১৮৫৫ সালের গবেষণাপত্র "On the Law which has regulated the Introduction of New Species" দুটোতে একই ধরনের চিন্তাধারার প্রমাণ পাওয়া যায় এবং মনে হয় ওয়ালেস একই ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছেন, এবং আরও লিখেন যে তিনি নিজে দুই বছরের মধ্যে তার নিজস্ব তত্ত্ব প্রকাশ করবেন।[৬৯] দ্বিতীয় চিঠির তারিখ ১৮৫৭ সালের ২২শে ডিসেম্বর যাতে লেখা, প্রাণীদের বণ্টন নিয়ে ওয়ালেসের কাজে তিনি খুবই খুশি, এবং সাথে যোগ করেন, "without speculation there is no good and original observation", পাশাপাশি মন্তব্য হিসেবে লিখেন "I believe I go much further than you".[৭০] ওয়ালেস তার কাজ সম্পর্কে ডারউইনের মন্তব্য বিশ্বাস করেন এবং তাকে তার ১৮৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে লেখা "On the Tendency of Varieties to Depart Indefinitely From the Original Type" নিবন্ধটি প্রেরণ করেন। তিনি ডারউইনকে এই লেখাটি রিভিউ করতে এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে চার্লস লায়েলকে দিতে অণুরোধ জানান।[৭১] ১৮৫৮ সালের ১৮ই জুন ডারউইন ওয়ালেসের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপিটি পান। এতে ডারউইনের পছন্দের "প্রাকৃতিক নির্বাচন" শব্দটি ছিল না, কিন্তু পরিবেশের চাপের কারণে একই বা কাছাঁকাছি ধরনের প্রজাতি থেকে যে ধীরে ধীরে ভিন্ন প্রজাতির উদ্ভব হতে পারে তা স্পষ্টভাবেই উল্লেখ ছিল। সেদিক থেকে ডারউইন গত বিশ বছর ধরে যে তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছেন কিন্তু তখনও প্রকাশ করেননি তার সাথে ওয়ালেসের তত্ত্বের পার্থক্য ছিল না বললেই চলে। ডারউইন পাণ্ডুলিপিটি লায়েলকে পাঠান এবং সাথে লিখেন, "এর চেয়ে ভাল সারাংশ আর হতে পারে না! এমনকি তার ব্যবহৃত কিছু শব্দ আমার কিছু অধ্যায়ের শিরোনাম হিসেবে শোভা পাচ্ছে... আমি তত্ত্বটি প্রকাশ করি তা সে চায় কিনা তা নিয়ে কিছু বলেনি, কিন্তু আমি অবশ্যই এখনই আমার তত্ত্বটি লিখে যেকোন জার্নালে পাঠাতে প্রস্তুত আছি।"[৭২] ডারউইন নিজের শিশু ছেলের অসুস্থতা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন এবং ওয়ালেসের আবিষ্কারের ব্যাপারটি সমাধা করার দায়িত্ব লায়েল ও হুকারের ওপর ছেড়ে দেন। লায়েল এবং হুকার ওয়ালেসের নিবন্ধটির সাথে ডারউইনের অপ্রকাশিত লেখার কিছু অংশ একসাথে এমনভাবে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন যাতে ডারউইনের অগ্রাধিকার স্পষ্ট বোঝা যায়। ওয়ালেস তার লেখা প্রকাশ করার ব্যাপারে কিছূ বলেননি, কিন্তু সে সময় দূরদেশে বসবাসকারী প্রকৃতিবিদদের লেখা তাদের অণুপস্থিতিতে ও বিনা অণুমতিতে প্রকাশ করাটা বেশ স্বাভাবিক ছিল। ১৮৫৮ সালের ১লা জুলাই ওয়ালেসের নিবন্ধ, ডারউইনের ১৮৪৭ সালে হুকারকে ব্যক্তিগতভাবে পড়তে দেয়া একটি নিবন্ধের সারাংশ এবং ১৮৫৭ সালে আশা গ্রে-কে ডারউইনের লেখা একটি চিঠি একসাথে লিনিয়ান সোসাইটি অফ লন্ডনে উপস্থাপন করা হয়।[৭৩] সুদূর মালয় দ্বীপপুঞ্জে বসবাসকারী ওয়ালেসের সাথে যোগাযোগ করতে অন্তত কয়েক মাস লেগে যেতো। তাই তিনি এই দ্রুত প্রকাশনার অংশ হতে পারেননি। পরে ব্যাপারটি জানার পর তিনি সানন্দেই মেনে নেন, তার নাম যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাতেই তিনি খুশি এবং পরবর্তী কোন সময়েই এ নিয়ে তার মধ্যে কোন ব্যক্তিগত রেশের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়নি। ডারউইনের সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক মর্যাদা ওয়ালেসের চেয়ে অনেক বেশি ছিল এবং ডারউইনের সাহায্য ছাড়া ওয়ালেসের ধারণা বিজ্ঞানী সমাজে গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হতো বলে মনে হয় না। লায়েল ও হুকারের সিদ্ধান্ত ওয়ালেসকে সহ-আবিষ্কারকের ভূমিকায় নামিয়ে দেয় এবং পরবর্তীতে কখনোই তিনি অন্য ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদদের সাথে সামাজিক মর্যাদায় এক ছিলেন না। তথাপি তাদের প্রবন্ধ একসাথে পড়ার কারণে প্রাকৃতিক নির্বাচনের আবিষ্কারক হিসেবে ডারউইনের সাথে সবসময় ওয়ালেসের নাম উচ্চারিত হয়। এই বিষয়টি এবং তার পক্ষে ডারউইন, লায়েল ও হুকারের প্রচারকার্য বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ে ওয়ালেসের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করেছিল।[৭৪] লিনিয়ান সোসাইটিতে প্রবন্ধগুলোর পঠন কোন তাৎক্ষণিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়নি, এমনকি ১৮৫৯ সালের মে মাসে সোসাইটির সভাপতি মন্তব্য করেন সে বছর নাকি কোন গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ঘটেনি।[৭৫] কিন্তু সে বছরের শেষের দিকে ডারউইনের অন দি অরিজিন অফ স্পিসিস প্রকাশের পর বিষয়টির গুরুত্ব প্রতিভাত হয়। ওয়ালেস যুক্তরাজ্য ফিরে এসে ডারউইনের সাথে দেখা করেন। ওয়ালেসের পরবর্তী কিছু সংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তাধারা ডারউইনের সহ্য করতে কষ্ট হলেও ডারউইনের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের বন্ধুত্ব বজায় ছিল। পরবর্তী সময়গুলোতে খুব কম মানুষই এই ইতিহাসের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছে। কিন্তু ১৯৮০-র দশকে আর্নল্ড ব্র্যাকম্যানের একটি বই এবং জন ল্যাংডনের আরেকটি বই দাবী করে ওয়ালেসকে নাকি তার প্রাপ্য মর্যাদা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা হয়েছে এবং ডারউইন নাকি তার তত্ত্ব শেষ করার জন্য ওয়ালেসের কাছ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা চুরি করেছেন। এই বক্তব্যগুলো বেশ কয়েকজন পণ্ডিত বিচার করে দেখেছেন এবং তাদের কাছে যুক্তিগুলো গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।[৭৬][৭৭][৭৮] সে সময়কার সমুদ্রযাত্রার রুটিন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ডারউইনের লায়েলকে লেখা চিঠিতে ওয়ালেসের চিঠি প্রাপ্তির যে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে তার আগে কোনভাবেই মালয় থেকে চিঠিটি পৌঁছানো সম্ভব ছিল না।[৭৯] ডারউইন ও নিজের ধারণার পক্ষ সমর্থন১৮৬২ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে আসার পর ওয়ালেস ডারউইনের সদ্য প্রকাশিত অন দি অরিজিন অফ স্পিসিস গ্রন্থের সবচেয়ে একনিষ্ঠ সমর্থকদের একজনে পরিণত হন। ইউনিভার্সিটি অফ ডাবলিনের একজন ভূতত্ত্বের অধ্যাপক ডারউইনের "অরিজিন" গ্রন্থে বর্ণীত ঘড়ভূজীয় মধুমক্ষিকাদের প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া বিবর্তিত হওয়ার বিষয়টির সমালোচনা করে একটি গবেষণাপত্র লিখেন। ১৮৬৩ সালে ওয়ালেস এই গবেষণাপত্রের যুক্তিগুলো খণ্ডন করে "Remarks on the Rev. S. Haughton's Paper on the Bee's Cell, And on the Origin of Species" নামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যা ডারউইনকে খুব সন্তুষ্ট করেছিল।[৮০] ডারউইনের ধারণাসমূহের আরও বিস্তারিত একটি সমর্থন তিনি প্রকাশ করেছিলেন "ক্রিয়েশন বাই ল" নামে যা ১৮৬৭ সালে দ্য কোয়ার্টারলি জার্নাল অফ সায়েন্স-এ প্রকাশিত হয়। এটি ছিল অ্যার্গিলের ৮ম ডিউক জর্জ ক্যাম্পবেলের প্রাকৃতিক নির্বাচনকে খণ্ডন করে লেখা বই "দ্য রেইন অফ ল" এর একটি রিভিউ।[৮১] ১৮৭০ সালে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের একটি সভা শেষে ওয়ালেস ডারউইনকে অণুযোগ করে লিখেছিলেন, "প্রাকৃতিক ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানেন এমন কোন প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিরোধীতাকারী অবশিষ্ট নেই, তাই আমরা যে ভাল আলোচনাগুলো আগে করতে পারতাম তা এখন আর সম্ভব নয়"।[৮২] প্রাকৃতিক নির্বাচন বিষয়ে ডারউইন ও ওয়ালেসের ধারণার পার্থক্যবিজ্ঞানের ইতিহাসবিদরা লক্ষ্য করেছেন যে, ডারউইন ওয়ালেসের গবেষণাপত্রের ধারণাগুলোকে হুবহু নিজের ধারণার মত মনে করলেও আসলে দুয়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে।[৮৩] ডারউইন একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে বেঁচে থাকা ও প্রজননের জন্য প্রতিযোগিতার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন, কিন্তু ওয়ালেস পরিবেশের প্রভাবের কারণে বিভিন্ন প্রকরণ ও প্রজাতির স্থানীয় প্রতিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য হওয়ার উপর জোড় দিয়েছেন।[৮৪][৮৫] অনেকের মতে আরকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হচ্ছে, ওয়ালেস সম্ভবত প্রাকৃতিক নির্বাচনকে এমন একটি ফিডব্যাক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেছেন যা বিভিন্ন প্রজাতি ও প্রকরণকে পরিবেশের জন্য সর্বদা উপযুক্ত রাখে।[৮৬] তারা ওয়ালেসের ১৮৫৮ সালের বিখ্যাত গবেষণাপত্রের একটি প্রায় উপেক্ষিত অনুচ্ছেদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন,
সাইবারনেটিশিয়ান ও নৃবিজ্ঞানী গ্রেগরি বেইটসন ১৮৭০ সালে বেশ সাধারণভাবে ও কেবল উদাহরণ দেয়ার জন্য একবার বলেছিলেন যে ওয়ালেস সম্ভবত ঊনবিংশ শতকের সবচেয়ে শক্তিশালী কথাটি বলেছেন।[৮৭] বেইটসন এই বিষয়টি নিয়ে তার ১৯৭৯ সালের বই Mind and Nature: A Necessary Unity-এ আবার আলোচনা করেন। অন্যান্য গবেষকরা প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাথে সিস্টেমস তত্ত্বের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন।[৮৬] সতর্কীকরণ বর্ণ ও যৌন নির্বাচন১৮৬৭ সালে ডারউইন একটি সমস্যা নিয়ে ওয়ালেসকে লিখেন- তিনি বুঝতে পারছিলেন না কীভাবে কিছু শুঁয়োপোকার দৃষ্টিনন্দন বর্ণের বিবর্তন ঘটেছে। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রাণীদের এরকম আকর্ষণীয় রঙের বিবর্তনের পেছনে যৌন নির্বাচনের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে (ওয়ালেস তার মত যৌন নির্বাচনের উপর এতোটা গুরুত্ব দেননি)। অবশ্য তিনি এও বুঝতে পেরেছিলেন, শুঁয়োপোকাদের ক্ষেত্রে যৌন নির্বাচনকে কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে না। উত্তরে ওয়ালেস লিখেন যে, তিনি এবং হেনরি বেইটস লক্ষ্য করেছিলেন সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন প্রজাপতিদের একটা বিদঘুটে গণ্ধ ও স্বাদ আছে, এবং জন জেনার উইয়ার নাকি তাকে বলেছিলেন পাখিরা বিশেষ এক ধরনের মথ কখনও খায় না কারণ সেটা তাদের কাছে বিস্বাদ লাগে। আরও লিখেন, সাদা মথ যেমন অন্ধকারে প্রকট, রঙিন মথ তেমনি দিনের আলোয় প্রকট- যা থেকে মনে হয় তাদের বর্ণ শিকারী প্রাণীদের জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করতে পারে। হয়তো তারা গায়ের রঙের মাধ্যমে শিকারীদের বোঝানোর চেষ্টা করে যে তাদেরকে খেলে বিপদ আছে। আর এটা সত্যি হলে রঙের বিবর্তনটা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমেই হতে পারে। ডারউইনের এই ধারণাটি ভাল লেগেছিল। পরবর্তীতে এন্টোমলজিক্যাল সোসাইটির একটি বৈঠকে ওয়ালেস জানতে চান কারও কাছে এই অণুকল্পের পক্ষে কোন ধরনের প্রমাণ আছে কিনা। ১৮৬৯ সালে উইয়ার উজ্জ্বল বর্ণবিশিষ্ট শুঁয়োপোকাদের পর্যবেক্ষণ এবং তৎসংশ্লিষ্ট কিছু পরীক্ষণের ফলাফল প্রকাশ করেন যা ওয়ালেসের প্রস্তাবনার পক্ষে যায়। প্রাণীদের বিভিন্ন বর্ণ ধারণ এবং বিশেষ করে নিজেকে রক্ষার জন্য গায়ের রঙ ব্যবহার বিষয়ক গবেষণায় ওয়ালেসের বেশ কিছু অবদানের মধ্যে সতর্কীকরণ বর্ণের ধারণা একটি।[৮৮] এছাড়া যৌন নির্বাচনের গুরুত্ব বিষয়ে ডারউইনের সাথে ওয়ালেসের আজীবন দ্বিমতের কারণগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। ১৮৭৮ সালের বই Tropical Nature and Other Essays-এ ওয়ালেস অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদের রঙ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং ডারউইন যৌন নির্বাচনকে কারণ হিসেবে দায়ী করেছিলেন এমন অনেকগুলো বিষয়ের ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন।[৮৯] ১৮৮৯ সালের বই ডারউইনিজম-এ বিষয়টি আবারও উঠে আসে। ১৮৯০ সালে নেচার জার্নালে বন্ধু এডওয়ার্ড ব্যাগনল পোল্টনের দি কালারস অফ অ্যানিমেলস শীর্ষক প্রবন্ধের সমালোচনা করে একটি রিভিউ লেখেন। ব্যাগনল বর্ণের বিবর্তনের কারণ হিসেবে ডারউইনের যৌন নির্বাচনকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং দাবী করেছিলেন কীটপতঙ্গদের নান্দনিক পছন্দ-অপছন্দ আছে। রিভিউটিতে ওয়ালেস বিশেষভাবে এই নান্দনিকতার ধারণাকে আক্রমণ করেন।[৯০] ওয়ালেস ক্রিয়া১৮৮৯ সালের বই ডারউইনিজম-এ ওয়ালেস প্রাকৃতিক নির্বাচন ব্যাখ্যা এবং পুরোপুরি সমর্থন করেন। এতে একটি নতুন অণুকল্পও প্রস্তাব করেন যা সংক্ষেপে এভাবে বলা যায়- একই প্রজাতির দুটি ভিন্ন প্রকরণের সদস্যদের মাঝে সংকরীকরণের (সংমিশ্রণ) অন্তরায়গুলোকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রজননগত বিচ্ছিন্নতা উস্কে দিতে পারে। এভাবে এটি নতুন প্রজাতির জন্মেও ভূমিকা রাখতে পারে। তার প্রস্তাবিত দৃশ্যপটটা ছিল এমন- যখন একই প্রজাতির দুটি ভিন্ন গোষ্ঠী একটি নির্দিষ্ট সীমার চেয়ে বেশি আলাদা হয়ে যায় তখন দুয়ের মিশ্রণের মাধ্যমে জন্ম নেয়া সন্তানের তুলনায় অবিমিশ্র ব্যক্তিরা পরিবেশের সাথে বেশি খাপ খাওয়াতে পারে, যথারীতি প্রাকৃতিক নির্বাচন সংকরের পরিবর্তে অবিমিশ্রদেরকেই প্রাধান্য দেয়, যার ফলে সংকরেরা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং প্রকরণ দুটি স্বাধীন প্রজাতি হওয়ার পথে ধাবিত হয়। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নির্বাচন সংকরীকরণের পথে বাঁধার সৃষ্টি করছে কারণ যারা মিশ্রণ এড়িয়ে চলেছে তাদের বংশধরেরাই বেশি উপযুক্ত। প্রজাতির উৎপত্তি বিষয়ক এই ধারণা পরবর্তীতে ওয়ালেস ক্রিয়া নামে পরিচিত হয়েছে।[৯১] ওয়ালেস সেই ১৮৬৮ সালেই সংকরীকরণের পথে প্রাকৃতিক নির্বাচনের বাঁধা বিষয়ে ডারউইনকে চিঠি লিখেছিলেন কিন্তু এতোদিন অণুকল্পটি এতো সূক্ষ্ণভাবে গঠন করতে পারেননি।[৯২] আধুনিক বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানেও এটি একটি গবেষণার বিষয়, এ যুগের কম্পিউটার সিমুলেশন এবং অনেক পরীক্ষণের ফলাফল ধারণাটি সমর্থন করছে।[৯৩] মানুষের ক্ষেত্রে তত্ত্বটির কার্যকারিতা ও ধর্মতত্ত্বের প্রভাব১৮৬৪ সালে ওয়ালেস "The Origin of Human Races and the Antiquity of Man Deduced from the Theory of 'Natural Selection'" নামে একটি গবেষণাপত্র লিখেন যাতে মানুষের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বটি প্রয়োগ করা হয়। ডারউইন তখনও এ বিষয়টি নিয়ে সামনাসামনি কিছু বলেননি, যদিও টমাস হাক্সলি তার Evidence as to Man's Place in Nature বইয়ে ইতোমধ্যেই এ নিয়ে আলোচনা করেন। ওয়ালেস গবেষণাপত্রটিতে অন্য প্রাণীদের তুলনায় মানব সম্প্রদায়ের আপেক্ষিক স্থিরতা এবং মানুষ ও গ্রেট এইপ তথা বৃহৎ নরবানরদের মস্তিষ্কের আকারে বিশাল পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করেন। সে সময়কার অনেক ডারউইনবাদী এমনকি ডারউইন নিজেও মনে করতো, আদিম অবস্থায় জীবন যাপনকারী মানবেরা মানুষ ও নরবানরদের মধ্যবর্তী বিশাল শূন্যস্থান প্রায় পূরণ করে। কিন্তু ওয়ালেস এটা মনে করতেন না।[৯৪] তিনি মানুষের বিবর্তনের দুটি ধাপ আছে: প্রথমত, দ্বিপদী হওয়ার মাধ্যমে মস্তিষ্কের আদেশ পালনের জন্য হাত দুটোকে মুক্ত করে ফেলা, এবং দ্বিতীয়ত, মস্তিষ্কের বিবর্তন যা পৃথিবীতে প্রাণের ইতিহাসে পুরো আলাদা একটা বিষয়। ওয়ালেসই বোধহয় প্রথম বিবর্তনবাদী যিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে, মস্তিষ্ক গঠন করার জন্য যত ধরনের দৈহিক পরিবর্তন প্রয়োজন তা হয়ে যাওয়ার পর সেই দৈহিক ব্যাপারগুলোই গৌণ হয়ে পড়েছে এবং মস্তিষ্কের বিকাশ সবকিছু ছাপিয়ে হয়ে উঠেছে মুখ্য।[৯৪] এই গবেষণাত্রের জন্য তিনি ডারউইনের প্রশংসা অর্জন করেন। এর পরপরই ওয়ালেস আধ্যাত্মবাদী হয়ে পড়েন। একই সাথে তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের সবচেয়ে সূক্ষ্ণ বৈশিষ্ট্যগুলোর বিবর্তন ঘটতে পারে না, যেমন, গাণিতিক, শৈল্পিক ও সঙ্গীত বিষয়ক মেধা, অধিবিদ্যাগত অণুধ্যান, বুদ্ধিদীপ্ততা ও রসবোধ। এক পর্যায়ে বলেছিলেন, "আত্মার জগৎের অদৃশ্য কিছু একটা" প্রাণের ইতিহাসে অন্তত তিন বার হস্তক্ষেপ করেছে। প্রথম বার অজৈব পদার্থ থেকে প্রাণ সৃষ্টির জন্য, দ্বিতীয় বার উন্নত প্রাণীদের মধ্যে চেতনার জন্ম দেয়ার জন্য এবং তৃতীয় বার মানুষের সবচেয়ে সূক্ষ্ণ মানসিক দক্ষতাগুলো তৈরির জন্য। এমনকি তিনি বিশ্বাস করতেন মহাবিশ্বের অস্তিত্বের কারণ মানব আত্মার জন্ম দেয়া।[৯৫] এই ধারণাগুলো ডারউইনকে বেশ বিরক্ত করে কারণ তিনি মনে করতেন আধ্যাত্মিকতা দিয়ে এসব ব্যাখ্যা করা অপ্রয়োজনীয় এবং যৌন নির্বাচনের মাধ্যমেই আপাতদৃষ্টিতে অভিযোজনীয় নয় এমন সব মানসিক ক্ষমতার উদ্ভব ব্যাখ্যা করা সম্ভব। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, মানুষের মন ও চেতনা ব্যাখ্যায় প্রাকৃতিক নির্বাচন যথেষ্ট নয়, ওয়ালেস এই ধারণা পোষণ করেছেন আধ্যাত্মিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাওয়ার কারণেই। অনেক ওয়ালেস গবেষকের মত আবার ভিন্ন, তাদের বক্তব্য, ওয়ালেস কোনকালেই মনে করতেন না প্রাকৃতিক নির্বাচন এসব বিষয়ে প্রযোজ্য।[৯৬][৯৭] ওয়ালেসের এই বিশ্বাসের প্রতি সমসাময়িক অন্য প্রকৃতিবিদদের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। চার্লস লায়েল ডারউইনের পরিবর্তে ওয়ালেসের ধারণা গ্রহণ করেন।[৯৮][৯৯] ঊনবিংশ শতকের শেষ এবং বিংশ শতকের প্রথম দিককার বেশ কয়েকজন বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী ওয়ালেসের মতোই মনে করতেন মানুষের চেতনা পুরোপুরি বস্তুগত উৎস থেকে জন্ম নিতে পারে না।[১০০] কিন্তু হাক্সলি, হুকার ও ডারউইন সহ অনেকেই এই ধারণার সমালোচনা করেছেন।[১০১] বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ মাইকেল শার্মার বলেছেন, ওয়ালেসের বিশ্বাস দুটি বড় কারণে সে সময়কার উদীয়মান ডারউইনীয় দর্শনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না- প্রথমত, বিবর্তন উদ্দেশ্যবাদী নয় অর্থাৎ সে কোন লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে না, আর দ্বিতীয়ত, বিবর্তন নৃকেন্দ্রিক নয় অর্থাৎ তা মানুষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় না।[১০২] জীবনের আরও পরের দিকে ওয়ালেস এ বিষয়ক ধারণায় আবার ফিরে এসেছিলেন। ১৯০৯ সালে একটি সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রবন্ধ "দ্য ওয়ার্ল্ড অফ লাইফ"-এ তিনি বলেন, বিবর্তন মহাবিশ্বের একটি উদ্দেশ্যের দিকে ইঙ্গিত করে এবং জীবন্ত সত্তাগুলোর কিছু বিষয় বা বৈশিষ্ট্য কেবল বস্তুগত উপায়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। প্রবন্ধটি পরে একই নামের একটি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল।[১০৩] শার্মারের মতে এই বইয়ে ওয়ালেস প্রকৃতিতে বুদ্ধিদীপ্ত নকশা (ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন) ও লক্ষ্যাভিমুখী বিবর্তন (directed evolution) বিষয়ক কিছু বিশ্বাস প্রকাশ করেন যা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে নানা রূপে ফিরে এসেছে। পুরো বিংশ শতাব্দী জুড়েই বিভিন্ন ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সম্প্রদায় তাদের বুদ্ধিদীপ্ত নকশার স্ব স্ব সংস্করণ উপস্থাপন করেছে।[১০০] বিবর্তন তত্ত্বের ইতিহাসে ওয়ালেসের অবস্থানবিবর্তনীয় তত্ত্ব আবিষ্কার বা বিনির্মাণের ইতিহাস বিষয়ক আলোচনায় অনেক সময়ই ওয়ালেসকে খুব হালকাভাবে উল্লেখ করা হয়, হয়তো কেবল ডারউইনের গবেষণা প্রকাশের উদ্দীপক হিসেবে।[১০৪] কিন্তু আসলে ওয়ালেস নিজে বিবর্তনের একটি স্বকীয় ধারণা দাঁড় করিয়েছিলেন যা কিছু দিক দিয়ে ডারউইনের ধারণার থেকে আলাদা। সমসাময়িক অনেকে, বিশেষ করে ডারউইন তাকে তদানীন্তন বিবর্তন গবেষক ও চিন্তাবিদদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন মনে করতেন। তার প্রস্তাবনা মোটেই অগ্রাহ্য করার মত ছিল না। একজন ইতিহাসবিদ দেখিয়েছেন, পারস্পরিক চিঠি ও প্রকাশিত গবেষণার মাধ্যমে তারা একটি দীর্ঘ সময় ধরে একে অপরের তত্ত্ব ও চিন্তাধারা উৎসাহিত ও সমৃদ্ধ করেছেন।[১০৫] ডারউইনের ডিসেন্ট অফ ম্যান গ্রন্থে সবচেয়ে বেশি যে ব্যক্তির উল্লেখ করা হয়েছে তিনি হলেন ওয়ালেস, অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিমত করার জন্য।[১০৬] ওয়ালেস আজীবন প্রাকৃতিক নির্বাচনের একজন প্রদীপ্ত সমর্থক ছিলেন। ১৮৮০-র দশকে বিবর্তন বিজ্ঞানী সমাজে প্রায় সর্বজন গৃহীত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ওয়ালেস ও আউগুস্ট ভাইসমান ছিলেন প্রায় একমাত্র বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী যারা প্রাকৃতিক নির্বাচনকে বিবর্তনের প্রধান চালিকাশক্তি বলে বিশ্বাস করতেন।[১০৭][১০৮] ওয়ালেস ডারউইনিজম নামক বইটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিরোধীদের যুক্তি খণ্ডন করার জন্যই লিখেছিলেন।[১০৯] তার সকল বইয়ের মধ্যে বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার জগৎে এটিই সবচেয়ে বেশি বার উল্লেখ হওয়া বই।[১১০] অন্যান্য বৈজ্ঞানিক অবদানজীবভূগোল ও বাস্তুতন্ত্র১৮৭২ সালে বেশ কয়েকজন বন্ধুর (যাদের মধ্যে ছিলেন ডারউইন, ফিলিপ স্ক্লেটার ও আলফ্রেড নিউটন) আবেদনে সাড়া দিয়ে ওয়ালেস পৃথিবীতে প্রাণীদের ভৌগোলিক বণ্টনের উপর একটি সাধারণ রিভিউ প্রণয়নের জন্য গবেষণা শুরু করেন। শুরুতে খুব একটা অগ্রসর হতে পারেননি কারণ তখন প্রাণীদের বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ ছিল।[১১১] ১৮৭৪ সালে শ্রেণিবিন্যাসের উপর বেশ কিছু নতুন গবেষণা প্রকাশিত হওয়ার পর কাজটি আবার শুরু করেন।[১১২] স্ক্লেটার পাখি প্রজাতিসমূহের ভৌগোলিক বণ্টন ব্যাখ্যার জন্য পৃথিবীকে ছয়টি অঞ্চলে ভাগ করেছিলেন। ওয়ালেস এই বিভাজন প্রক্রিয়াকে আরও বর্ধিত করেন যাতে করে স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ ও পোকামাকড়দের বণ্টনও ব্যাখ্যা করা যায়। প্রাণীদের যে ভৌগোলিক বণ্টন ব্যবস্থা আজ বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত ওয়ালেসই তার ভিত্তি তৈরি করেছিলেন। প্রতিটি অঞ্চলে বর্তমান এবং অতীতের সকল প্রাণীর বণ্টন ব্যাখ্যার জন্য যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ তার সবগুলো নিয়েই তিনি আলোচনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে, স্থলসেতুর (land bridge, যেমন বর্তমান উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার সংযোগকারী স্থলপথ) উদয় ও বিলুপ্তি এবং প্রবল হিমবাহের প্রভাব। তার তৈরি করা মানচিত্রগুলো প্রাণীদের বণ্টনের উপর বিভিন্ন বিষয় যেমন, পর্বতমালার উচ্চতা, সমুদ্রের গভীরতা, আঞ্চলিক উদ্ভিদজগৎ ইত্যাদির প্রভাব তুলে ধরে। এছাড়া তিনি সে সময় জানা সকল উচ্চতর প্রাণীদের পরিবার ও গোত্রের নাম এবং ভৌগোলিক ব্যাপ্তি লিপিবদ্ধ করেন। লেখাগুলো এমনভাবে সাজিয়েছিলেন যাতে একজন পরিব্রাজক পড়েই বুঝতে পারে কোন এলাকায় কেমন প্রাণী পাওয়া যায়। এ বিষয়ক সকল গবেষণা ১৮৭৬ সালে দ্য জিওগ্রাফিক্যাল ডিস্ট্রিবিউশন অফ অ্যানিমেল্স (The Geographical Distribution of Animals) নামে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়। পরবর্তী ৮০ বছর ধরে এটিই ছিল প্রাণীভূগোলের উপর সর্বাধিক পঠিত ও গুরুত্বপূর্ণ বই।[১১৩] ১৮৮০ সালে ওয়ালেস দ্য জিওগ্রাফিক্যাল ডিস্ট্রিবিউশন অফ অ্যানিমেল্স বইয়ের ধারাবাহিকতায় আইল্যান্ড লাইফ লিখেন। এতে প্রাণীর পাশাপাশি বিভিন্ন দ্বীপের উদ্ভিদদেরকেও জরিপের আওতায় আনা হয়। তিনি দ্বীপগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করেছিলেন। মহাসাগরীয় দ্বীপ যেমন গালাপাগোস এবং হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ (তখন স্যান্ডউইচ দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত ছিল) মধ্যসমুদ্রে জন্ম নিয়েছিল এবং কখনও কোন মহাদেশীয় মূলভূমির সংস্পর্শে আসেনি। যার ফলে এই দ্বীপগুলোতে মূলভূমির স্তন্যপায়ী ও উভচরদের কোনটিই নেই, এবং তাদের অধিবাসীরা মূলত (কিছু পরিযায়ী পাখি এবং মানুষের হাতে স্থানান্তরিত প্রজাতিগুলো ছাড়া) মূলভূমি থেকে দুর্ঘটনাবশত আসা। এরপর আসে মহাদেশীয় দ্বীপের কথা, যারা কখনও না কখনও মূলভূমির সংস্পর্শে এসেছিল। এই দ্বীপগুলোকে আবার দুই ভাগে ভাগ করেন- যারা নিকট অতীতে কোন মহাদেশের অংশ ছিল (যেমন ব্রিটেন) এবং যারা নিকট অতীতে তেমনটি ছিল না (যেমন মাদাগাস্কার)। মহাদেশ থেকে তারা কতকাল ধরে আলাদা আছে তার উপরও সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণীর বণ্টন নির্ভর করে যেটা ওয়ালেস দেখিয়েছেন। এছাড়া তিনি লিখেছেন, বিচ্ছিন্নতা কীভাবে বিবর্তনের উপর প্রভাব ফেলে এবং কিছু বিশেষ প্রাণীকে সংরক্ষণ করে রাখতে পারে। যেমন মাদাগাস্কারের লেমুর, যারা সুদূর অতীতের একটি মহাদেশীয় প্রজাতির অবশিষ্টাংশ। জলবায়ু পরিবর্তন ও তীব্র হিমবাহ কীভাবে দ্বীপের উদ্ভিদ ও প্রাণীদের প্রভাবিত করে সে নিয়ে তার বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে, এমনকি এই তুষার যুগগুলো কেন ঘটেছিল সে বিষয়েও কিছু অণুকল্প প্রস্তাব করেন। প্রকাশের সময় আইল্যান্ড লাইফ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। অন্যান্য বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনায় এর কথা বারংবার উঠে এসেছে।[১১৪] পরিবেশগত বিষয়াদিজৈব-ভূগোল নিয়ে অনেক কাজ করায় ওয়ালেস প্রাকৃতিক বিশ্বের উপর মানব কার্যক্রমের প্রভাব উপলব্ধি করেন। ট্রপিক্যাল নেচার অ্যান্ড আদার এসেস (Tropical Nature and Other Essays) নামক বইয়ে তিনি বনাঞ্চল ধ্বংস ও মাটির ক্ষয়সাধনের (বিশেষ করে ক্রান্তীয় অঞ্চলে যেখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে) ব্যাপারে সবাইকে হুশিয়ার করেন। উদ্ভিদজগতের সাথে জলবায়ুর গভীর সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে তিনি বলেন, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় কফি উৎপাদনের জন্য বিপুল সংখ্যক গাছ কেটে ফেলার কারণে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে, মাটি তার স্বাভাবিক উর্বরতা হারাবে এবং সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য বাড়বে।[১১৫] আইল্যান্ড লাইফ-এ তিনি আবারও বৃক্ষনিধন নিয়ে আলোচনা করেন, এর পাশাপাশি উঠে আসে অধিক্রমী প্রজাতিদের (ইনভেসিভ) প্রভাবের বিষয়টি। সেন্ট হেলেনা দ্বীপের উপর ইউরোপীয় উপনিবেশের প্রভাব নিয়ে লিখেছিলেন:
জ্যোতির্জীববিজ্ঞানওয়ালেসের ১৯০৪ সালের বই ম্যান'স প্লেইস ইন দি ইউনিভার্স-প্রকাশিত হওয়ার আগে কোন জীববিজ্ঞানী ভিনগ্রহে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখেননি। তিনি সিদ্ধান্ত টানেন, আমাদের সৌরজগতে একমাত্র পৃথিবীই প্রাণ ধারণে সক্ষম কারণ একমাত্র এখানেই পানি তরল অবস্থায় থাকতে পারে। তবে তিনি আরও মনে করতেন, আমাদের গ্যালাক্সিতে সূর্য ছাড়া অন্য কোন তারার চারপাশে প্রাণ ধারণে সক্ষম গ্রহ থাকার সম্ভাবনা খুব কম। আর সে সময় আমাদেরটি ছাড়া অন্য কোন গ্যালাক্সির অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়নি। এই বইয়ে মঙ্গল গ্রহ নিয়ে খুব সংক্ষেপে আলোচনা করেছিলেন কিন্তু ১৯০৭ সালে ইজ মার্স হ্যাবিটেবল? (মঙ্গল কি বাসযোগ্য) নামে একটি আলাদা বইই লিখেন। এর আগে পার্সিভাল লাওয়েল মঙ্গলে খালের মত কাঠামো আবিষ্কার করে দাবী করেছিলেন এগুলো বুদ্ধিমান প্রাণীদের তৈরি। এই ধারণাকে সমালোচনা করাই ওয়ালেসের বইটি লেখার উদ্দেশ্য ছিল। তিনি বেশ কয়েক মাস ধরে মঙ্গল নিয়ে গবেষণা করেন এবং গ্রহটির বায়ুমণ্ডল ও জলবায়ু বিষয়ে নিজস্ব বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দাঁড়া করান।[১১৭] অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি তিনি ধরিয়ে দেন যে, বর্ণালী বিশ্লেষণ করে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে কোন জলীয় বাষ্পের সন্ধান পাওয়া যায়নি, এবং লাওয়েলের মঙ্গলের জলবায়ু বিষয়ক কাজ ভয়ানক ত্রুটিপূর্ণ। লাওয়েল তরল পানির অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য মঙ্গল পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও বায়ুমণ্ডলীয় চাপ যত অণুমান করেছেন ওয়ালেস বলেন, বাস্তবতা তার চাইতে অনেক ভিন্ন।[১১৮] রিচার্ড মিলনার মন্তব্য করেছিলেন, লাওয়েলের জাদুকরীয় মঙ্গলীয় খালের ধারণা ভুল প্রমাণের কৃতিত্ব মেধাবী ও খামখেয়ালি বিবর্তনবিদ আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস।[১১৯] ওয়ালেস প্রথমে এই বিষয়ক গবেষণায় উৎসাহী হয়েছিলেন কারণ তিনি মনে করতেন মানুষ পুরো মহাবিশ্বেই একটি অনন্য সত্ত্বা, যাকে নৃকেন্দ্রিক দর্শন বলা যায়।[১২০] বিতর্কিত বিষয়সমূহআধ্যাত্মিকতাস্ত্রীর ভাইকে ১৮৬১ সালের একটি চিঠিতে ওয়ালেস লিখেছিলেন:
তিনি ফ্রেনোলজি (মানুষের মাথার খুলি পরিমাপের মাধ্যমে তার মন সম্পর্কে ধারণা লাভের একটি ছদ্মবিজ্ঞান) খুব পছন্দ করতেন।[১২২] ক্যারিয়ারের একেবারে শুরুর দিকে সম্মোহন নিয়ে কিছু পরীক্ষা করেন যাকে তখন "মেসমারিজম" (mesmerism) বলা হতো। লেস্টারে তার কয়েকজন ছাত্রের উপর পরীক্ষা চালিয়ে সফলও হয়েছিলেন।[১২৩] সে সময় মেসমারিজম খুব বিতর্কিত বিষয় ছিল, এবং অন্যান্যদের মধ্যে বিশেষ করে জন এলিয়টসনের এ বিষয়ক পরীক্ষা চিকিৎসক ও সাধারণভাবে বিজ্ঞানীদের কাছে প্রচুর সমালোচনার শিকার হয়।[১২৪] মেসমারিজম এবং পরবর্তীতে নিজের আধ্যাত্মিকতা বিষয়খ কাজগুলোর মধ্যে ওয়ালেস একটি যোগসূত্র রচনা করতে চেয়েছিলেন। ১৮৯৩ সালে লিখেন:
১৮৬৫ সালের গ্রীষ্মকালে ওয়ালেস আধ্যাত্মিকতা নিয়ে কাজ শুরু করেন। এর পেছনে সম্ভবত তার বড় বোন ফ্যানি সিমসের উৎসাহ কাজ করেছিল যিনি আগেই আধ্যাত্মিকতার অণুসন্ধান করতেন।[১২৬] প্রথমে এ বিষয়ক কিছু বই ও রচনা পাঠের পর ওয়ালেস নিজে আধ্যাত্মিক ঘটনা পরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা করেন। সায়ান্স (প্রেতসাধনা, মৃত আত্মার সাথে যোগাযোগ) বিষয়ক একটি অভিজ্ঞতা পরীক্ষা করতে গিয়ে তিনি ভাবেন, এই বিশ্বাসের সাথে সম্ভবত কোন প্রাকৃতিক বাস্তবতার সম্পর্ক আছে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকে আজীবন তিনি বিশ্বাস করতেন, অসংখ্য মিথ্যাচার ও জালিয়াতির উদাহরণ থাকলেও কিছু সায়ান্সের ঘটনা সত্য হতে বাধ্য। কোন ঘটনা তার আধ্যাত্মিকতা বরণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল সে নিয়ে ইতিহাসবিদ ও জীবনীকারদের মধ্যে বিতর্ক আছে। একজন জীবনীকারের মতে, মাত্র কয়েকমাস আগে তার বাগদত্তা তাদের বিয়ে ভেঙে দেয়ার পর তার মধ্যে যে হতাশার জন্ম হয়েছিল তা তাকে আধ্যাত্মিকতা গ্রহণে সাহায্য করে থাকতে পারে।[১২৭] অন্য অনেক পণ্ডিতের মতে, এটি ওয়ালেসের পৃথিবীর সবকিছুর একটি যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আবিষ্কারের প্রয়াসের অংশ। তিনি বস্তুগত, অবস্তুগত, প্রাকৃতিক, আপাতদৃষ্টিতে অতিপ্রাকৃতিক এবং সার্বিকভাবে মানব সমাজের সবকিছুর ব্যাখ্যা খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন।[১২৪][১২৮] ভিক্টোরীয় যুগের অনেক শিক্ষাবিদ ও পণ্ডিতই আধ্যাত্মিকতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সে সময়কার প্রতিষ্ঠিত ধর্ম তথা ইংল্যান্ডের চার্চের প্রতি তাদের আস্থা ছিল না, প্রথাগত ধর্মে তারা বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু অন্যদিকে ঊনবিংশ শতকের বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ বিশ্বের যে পুরোপুরি বস্তুবাদী ও যান্ত্রিক ব্যাখ্যার উপর জোড় দিচ্ছিল সেটাও তারা গ্রহণ করতে পারেননি।[১২৯] অবশ্য, অনেক গবেষক ধরিয়ে দিয়েছেন, ওয়ালেসের কাছে আধ্যাত্মিকতা ধর্মীয় বিশ্বাস নয় বরং বিজ্ঞান ও দর্শনেরই ব্যাপার ছিল।[১২৪][১২৮] আধ্যাত্মিকতার সাথে জড়িত ঊনবিংশ শতকের অন্যান্য বিখ্যাত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আছেন রবার্ট ওয়েন (ওয়ালেসের প্রথম আদর্শ ব্যক্তিদের একজন)[১৩০], পদার্থবিজ্ঞানী উইলিয়াম ক্রুক্স ও লর্ড রেলি, গণিতবিদ অগাস্টাস ডি মরগ্যান, এবং স্কটিশ প্রকাশক রবার্ট চেম্বার্স।[১২৯][১৩১] ওয়ালেস বেশ প্রকাশ্যভাবে আধ্যাত্মিকতা সমর্থন করেছেন এবং ১৮৭০-এর দশকে আধ্যাত্মিকতার নামে জালিয়াতির প্রচুর অভিযোগের বিরুদ্ধে যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এসব কারণে বিজ্ঞানী সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। এর আগে বন্ধুবৎসল বিজ্ঞানী যেমন, হেনরি বেইট্স, টমাস হাক্সলি এবং এমনকি ডারউইনের সাথেও তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। চিকিসক উইলিয়াম বেঞ্জামিন কার্পেন্টার ও প্রাণিবিজ্ঞানী ই রেই ল্যাংকাস্টার প্রকাশ্যে ও বেশ কঠোরভাবে ওয়ালেসের সমালোচনা করেন। ওয়ালেস এবং আধ্যাত্মিকতার পক্ষে ওকালতি করা অন্য বিজ্ঞানী উইলিয়াম ক্রুক্স সংবাদ মাধ্যমেও অনেক সমালোচনার শিকার হন। সে সময়কার প্রধান চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যান্সেট তাদের প্রতি বিশেষভাবে ক্রূর ছিল। ক্যারিয়ারের বাকি সময় জুড়ে ওয়ালেসের অন্যান্য কাজও এসব সমালোচনার কারণে কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা হারায়।[১৩২] ১৮৭৯ সালে যখন ডারউইন ওয়ালেসের জন্য একটি সরকারি পেনশন জোগাড় করে দেয়ার জন্য অন্যান্য প্রকৃতিবিদদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন, তখন উত্তরে জোসেফ হুকার বলেন:
অবশ্য পরে হুকার তার অবস্থান থেকে সরে এসে পেনশনের পক্ষে মত দেন।[১৩৪] সমতল পৃথিবী বিষয়ক বাজি১৮৭০ সালে জন হ্যাম্পডেন (John Hampden) সমতল পৃথিবীর ধারণার পক্ষে বাজি ধরেন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তিনি ঘোষণা দেন, কেউ যদি নদী, হ্রদ বা খালের পৃষ্ঠে কোন ধরনের বক্রতার প্রমাণ হাজির করতে পারে তাহলে তাকে ৫০০ পাউন্ড (বর্তমানের ৩৫,০০০ পাউন্ড তথা প্রায় ৪৩ লক্ষ বাংলাদেশী টাকার সমতুল্য) দেবেন। ওয়ালেসের ব্যাপারটি আকর্ষণীয় মনে হয়, এছাড়া তখন তার কিছুটা অর্থকষ্টও চিল। তিনি একটি খালের উপর প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরত্বে এবং পানির পৃষ্ঠ থেকে সমান উচ্চতায় দুটি বস্তু স্থাপন করেন, এরপর এদের মাঝখানে সমান উচ্চতায় একটি দুরবিন বসান। দুরবিন দিয়ে একটি বস্তুকে অন্যটির তুলনায় উপরে দেখা যায় যা স্পষ্টভাবে পৃথিবীর বক্রতা প্রমাণ করে। বাজিটির বিচারক "ফিল্ড" সাময়িকীর সম্পাদক ওয়ালেসকে জয়ী ঘোষণা করলেও হ্যাম্পডেন তা মেনে নিতে রাজি হননি। তিনি ওয়ালেসের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন এবং পরবর্তী কয়েক বছর ধরে তার বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালান, ওয়ালেসের সদস্যপদ রয়েছে এমন সব সংগঠন ও প্রকাশনীতে চিঠি লিখে তাকে চোর ও প্রতারক হিসেবে অভিযুক্ত করেন। ওয়ালেস কয়েকটি মামলায় জিতেন, কিন্তু মামলার পেছনে তার যত অর্থ খরচ হয় তা বাজি থেকে পাওয়া অর্থের চেয়েও বেশি। এসব কারণে ওয়ালেস কয়েক বছর বেশ হতাশ ছিলেন।[১৩৫] টিকাদান কর্মসূচীর বিরোধিতা১৮৮০-র দশকের প্রথম দিকে গুটিবসন্ত প্রতিরোধের জন্য টিকাদান বাধ্যতামূলক করার বিতর্কে ওয়ালেসও জড়িয়ে পড়েন। প্রথমে তিনি ব্যাপারটিকে ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয় ভাবতেন, কিন্তু পরবর্তীতে টিকাদান কর্মসূচীর বিরোধিদের দ্বারা পরিচালিত কিছু পরিসংখ্যান দেখে তিনি টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন। সে সময় রোগের জীবাণু তত্ত্ব ছিল নতুন আবিষ্কার এবং তখনও তা সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। উপরন্তু টিকা কেন কাজ করে তা বোঝার জন্য মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে যতটুকু জানা দরকার ততোটা মানুষ জানতো না। কিছু গবেষণা করতে গিয়ে ওয়ালেস লক্ষ্য করেন, টিকাদানের সমর্থকরা অনেক সময় এই কর্মসূচীর ফলপ্রসূতা প্রমাণের জন্য সন্দেহজনক ও ক্ষেত্রবিশেষে মিথ্যা পরিসংখ্যান ব্যবহার করে। তিনি সব সময়ই কর্তৃপক্ষদের সন্দেহের চোখে দেখতেন। তাই এবারও ভেবে বসেন, সম্ভবত টিকাদান প্রচারের পেছনে ডাক্তারদের কোন স্বার্থ আছে, এবং বর্তমানে গুটিবসন্তের প্রকোপ কমে যাওয়ার কারণ টিকাদান নয় বরং মানুষের সাধারণ স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি।[১৩৬] তার বিরোধিতার আরেকটি কারণ প্রাকৃতিক নির্বাচন বিষয়ে তার ভাবনা। তিনি ভাবতেন, প্রকৃতিতে সকল জীব প্রাকৃতিক নির্বাচনের চাপে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় বিরাজ করে এবং ক্ষতিকর বিষয়গুলো নির্বাচনের কারণেই অতোটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। সে হিসেবে সকল প্রাকৃতিক জীব, এমনকি রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুদেরও প্রকৃতির বিশাল প্রেক্ষাপটে কোন উপকারী ভূমিকা আছে। তিনি ভেবেছিলেন, টিকাদান এই প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে নষ্ট করে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফলের জন্ম দিতে পারে।[১৩৭] ওয়ালেস এবং অন্য টিকাদান-বিরোধীরা এটাও ধরিয়ে দিয়েছিলেন যে, টিকাদান, যা তখন বেশ অস্বাস্থকর পরিবেশে করা হতো, ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের জন্য ভয়ংকর হতে পারে।[১৩৭] ১৮৯০ সালে ওয়ালেস তার মতামতের পক্ষে রয়েল কমিশনে কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করেন। কমিশন তার প্রমাণগুলো খতিয়ে দেখতে গিয়ে তাতে বেশ কিছু ভুল ও সন্দেহজনক পরিসংখ্যান পায়। দ্য ল্যান্সেট লিখে, ওয়ালেস ও অন্য টিকাদান-বিরোধীরা পরিসংখ্যান তৈরির সময় বেছে বেছে তাদের পক্ষে যায় এমন সব বিষয় নির্বাচন করছে, এবং তাদের মতামতের বিরোধী বিপুল পরিমাণ উপাত্ত পুরোপুরি এড়িয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কমিশনটি গুটিবসন্তের টিকা বাধ্যতামূলক রাখার পক্ষে রায় দেয়, অবশ্য সেই টিকাদানের প্রক্রিয়া ও পরিবেশ আরও স্বাস্থ্যকর করার দিকে নজর দিতে বলা হয় এবং টিকা নিতে অস্বীকারকারীদের শাস্তি আরও লঘু করা হয়। এর অনেক পরে ১৮৯৮ সালে ওয়ালেস কমিশনের সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করে Vaccination a Delusion; Its Penal Enforcement a Crime নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। দ্য ল্যান্সেট আবারও তার পুস্তিকাটির সমালোচনা করে এবং উল্লেখ করে যে, এতে পূর্বের মতোই অনেক ভুল ও সন্দেহজনক পরিসংখ্যান রয়ে গেছে।[১৩৬] ঐতিহাসিক ভাবমূর্তিপ্রচুর রচনার কারণে মৃত্যুর সময় ওয়ালেস বিজ্ঞানী এবং সমাজকর্মী হিসেবে বেশ বিখ্যাত ও সুপরিচিত ছিলেন। জীবদ্দশায় সাংবাদিকরা প্রায়ই বিভিন্ন বিষয়ে তার মতামত নিতে চাইতো।[১৩৮] সম্মানসূচক ডক্টরেটসহ বেশকিছু পেশাগত সম্মাননা পান, যেমন রয়েল সোসাইটির সদস্যপদ লাভ, কপলি পদক অর্জন, এবং ব্রিটেনের রাজপরিবার থেকে একটি উপাধি (অর্ডার অফ মেরিট) প্রাপ্তি।[১৩৯] তবে ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে ডারউইনের সাথে যৌথভাবে "প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন" আবিষ্কার এবং প্রাণী-ভূগোল বিষয়ক কাজ। তিনি নিঃসন্দেহে ঊনবিংশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক ইতিহাস গবেষকদের একজন। এতো কিছু সত্ত্বেও মৃত্যুর পর তার খ্যাতি দ্রুত ম্লান হয়ে যায়। একটা দীর্ঘ সময় বিজ্ঞানের ইতিহাসে তিনি কেবল একটি নিষ্প্রতিভ চরিত্র ছিলেন।[১০৪] এর কারণ হিসেবে বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে আছে তার বিনয়, নিজের খ্যাতির প্রতি নজর না রেখেই অখ্যাত ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ের পক্ষে প্রচারণা, এবং তার বেশ কিছু প্রথাবিরুদ্ধ ধারণার সাথে বিজ্ঞানী সম্প্রদায়ের বিরোধ। তবে সম্প্রতি তিনি আর অতোটা অখ্যাত চরিত্র নেই, যার মূল কারণ তার জীবনী নিয়ে লেখা বেশ কিছু পূর্ণদৈর্ঘ্য বই এবং তার রচনাসমগ্র প্রকাশ। ২০০৭ সালে "নিউ ইয়র্কার" সাময়িকীর একজন সাহিত্য সমালোচক লিখেন, ২০০০ সালের পর থেকে তার পাঁচটি জীবনী এবং দুটি রচনাসমগ্র প্রকাশিত হয়েছে।[১৪০] এছাড়া ওয়ালেসের জীবন ও কর্ম তুলে ধরার জন্য একটি ওয়েবসাইটও নির্মাণ করা হয়েছে।[১৪১] পুরস্কার, সম্মাননা, ও স্মারক
ওয়ালেসের রচনাওয়ালেস অনেক লিখেছেন। ২০০২ সালে একজন বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ ওয়ালেসের সকল প্রকাশনার একটি পরিমাণবাচক বিশ্লেষণ প্রকাশ করেন। তিনি দেখেন, ওয়ালেস জীবনে ২২টি পূর্ণদৈর্ঘ্য বই এবং অন্তত ৭৪৭টি অপেক্ষাকৃত ছোট লেখা লিখেছেন। ছোট লেখাগুলোর বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রের সংখ্যা ৫০৮টি যার মধ্যে ১৯১টি পৃথিবীর অন্যতম সেরা বৈজ্ঞানিক জার্নাল নেচার-এ প্রকাশিত হয়। এছাড়া তিনি ৭৪৭টি ছোট লেখাকে প্রধান বিষয় অনুযায়ী ভাগ করেন। দেখা যায় ২৯% এর বিষয় জৈব-ভূগোল ও প্রাকৃতিক ইতিহাস, ২৭% এর বিবর্তন তত্ত্ব, ২৫% এর সামাজিক ভাষ্য, ১২% এর নৃবিজ্ঞান, এবং ৭% এর বিষয় আধ্যাত্মিকতা ও ফ্রেনোলজি।[১৪৪] ওয়ালেসের লেখার একটি অনলাইন বিবলিওগ্রাফিতে ৭৫০ টিরও বেশি ভুক্তি আছে।[২৩] নির্বাচিত কিছু বই
নির্বাচিত গবেষণাপত্র
ইতিহাসবিদ চার্লস এইচ স্মিথ The Alfred Russel Wallace Page ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৫ এপ্রিল ২০০৭ তারিখে ওয়েবসাইটে ওয়ালেসের সকল প্রকাশনার তালিকা ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮ তারিখে এবং কিছু বই ও রচনা তুলে রেখেছেন।[২৩] পাদটীকা
তথ্যসূত্রএই নিবন্ধ ইংরেজি উইকিপিডিয়ার নিবন্ধটির অনুবাদ। ইংরেজি নিবন্ধটি লেখার ক্ষেত্রে ইংরেজি উইকিপিডিয়ার লেখকেরা যে সূত্রগুলো ব্যবহার করেছেন সেগুলোর তালিকা লেখকের শেষ নামের আদ্যক্ষর অনুযায়ী নিচে উল্লেখ করা হল। নিবন্ধটির কোন অংশ এই সূত্রগুলোর কোনটি থেকে নেয়া হয়েছে তা "পাদটীকা" দ্রষ্টব্য।
আরও পড়ুন
বহিঃসংযোগউইকিউক্তিতে আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস সম্পর্কিত উক্তির সংকলন রয়েছে। উইকিমিডিয়া কমন্সে আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস সংক্রান্ত মিডিয়া রয়েছে।
|