জর্জ হ্যাডলি
জর্জ আলফনসো হ্যাডলি, ওডি (ইংরেজি: George Alphonso Headley; জন্ম: ৩০ মে, ১৯০৯ - মৃত্যু: ৩০ নভেম্বর, ১৯৮৩) পানামায় জন্মগ্রহণকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিখ্যাত টেস্ট ক্রিকেট তারকা ছিলেন। খেলোয়াড়ী জীবনে ২২টি টেস্ট ম্যাচ খেললেও অধিকাংশ টেস্টই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে। তাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তথা সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। এছাড়াও, তিনি জ্যামাইকা দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। পাশাপাশি ইংল্যান্ডের পেশাদার ক্লাব ক্রিকেটেও অংশগ্রহণ করেন জর্জ হ্যাডলি। ১৯৩৪ সালে তাকে উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটারের সম্মানে ভূষিত করা হয়।[১] প্রারম্ভিক জীবন৩০ মে, ১৯০৯ তারিখে ডিকোর্সি হ্যাডলি ও ইরিন রবার্টস দম্পতির পুত্র জর্জ হ্যাডলি পানামার কোলন এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা 'ডিকোর্সি হ্যাডলি' ছিলেন বার্বাডোস ও মা 'ইরিন' ছিলেন জ্যামাইকার নাগরিক। পানামা খালের অবকাঠামো নির্মাণের সাথে বাবা সম্পৃক্ত ছিলেন। হ্যাডলির পাঁচ বছর বয়সে খালের খনন কার্য সম্পন্ন হলে পরিবার কিউবায় চাকুরীর সন্ধানে চলে যান। ১৯১৯ সালে স্পেনীয় ভাষায় দক্ষ পুত্রকে নিয়ে মা জ্যামাইকায় ফিরে যান ও ইংরেজিভাষী বিদ্যালয়ে ভর্তি করান।[২] মায়ের আত্মীয়া মিসেস ক্ল্যারেন্স স্মিথের সাথে জ্যামাইকার কিংস্টনের রে টাউন এলাকায় স্থানান্তরিত হন ও স্মিথের মৃত্যু-পূর্ব ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেন।[২][৩] তার মা কিউবায় ফিরে গেলেও নিয়মিত পত্র যোগাযোগ রক্ষা করতেন।[২] কালাবার এলিমেন্টারি স্কুলে অধ্যয়নকালীন তিনি বিদ্যালয় দলের উইকেট-রক্ষক ছিলেন। কিন্তু বাজেট স্বল্পতায় তিনি গ্লাভসবিহীন অবস্থায় দায়িত্ব পালন করতেন।[৪] স্থানীয় ক্র্যাবহোল পার্কে সারাদিনের খেলায় তিনি দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষমতা অর্জন করেন।[৫] ১৬ বছর বয়সে তিনি রেটাউন ক্রিকেট ক্লাবে যোগ দেন। ১৯২৫ সালে তিন নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে তিনি তার প্রথম সেঞ্চুরি হাঁকান ক্লোভেলি দলের বিপক্ষে।[৬] খেলোয়াড়ী জীবনজ্যামাইকায় ক্রিকেট উপযোগী পরিবেশে ব্যাটসম্যান হিসেবে বেড়ে উঠার ফলে তিনি জ্যামাইকান ক্রিকেট দলে জায়গা করে নেন। কিন্তু অল্পের জন্য ১৯২৮ সালে ইংল্যান্ড সফরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে জায়গা পাননি। অতঃপর ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩০ তারিখে বার্বাডোসে অনুষ্ঠিত ইংল্যান্ড দলের বিপক্ষে তার টেস্ট অভিষেক ঘটে ও শুরুতেই সফলতার মুখ দেখেন। ঐ খেলায় ইংল্যান্ডের পক্ষে এফএসজি ক্যালথর্প, ডব্লিউ ভোস এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে এফআই ডি কেয়ার্স, জিএ হ্যাডলি, ইএসি হান্ট, জেইডি সিলি, এডউইন সেন্ট হিল এবং এলএ ওয়ালকটের একযোগে টেস্ট অভিষেক ঘটেছিল। তিন নম্বরে ব্যাটিংয়ে নামেন তিনি। আক্রমণাত্মক ঢংয়ে প্রথম ইনিংসে করেন ২১ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে করেন ১৭৬ রান। এরফলে প্রথম ও সর্বকনিষ্ঠ ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান হিসেবে টেস্ট ক্রিকেট অভিষেকে সেঞ্চুরি করার বিরল গৌরবগাঁথা রচনা করেন। তার এ সেঞ্চুরিটি ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে সর্বসাকুল্যে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি ছিল। পরবর্তীতে অবশ্য ২৬ নভেম্বর, ২০০৯ তারিখে গাব্বায় স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আদ্রিয়ান বারাথ সর্বকনিষ্ঠ ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান সেঞ্চুরিকারী হন।[৭] ক্লিফোর্ড রোচ ও ফ্রাঙ্ক ডি কেয়ার্সের সাথে শতরানের জুটি গড়েন। তাস্বত্ত্বেও খেলাটি ড্রয়ে পরিণত হয়েছিল। রোচসহ তিনিই কেবলমাত্র চার টেস্টের সিরিজের সবগুলোতেই অংশগ্রহণ করেছিলেন। ত্রিনিদাদে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় টেস্টে ব্যাটিং পিচে বেশ প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হন তিনি। ৮ ও ৩৯ রান তোলেন। খেলায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ পরাজিত হয়েছিল। সিরিজের তৃতীয় খেলায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাদের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম জয়ের সন্ধান পায়। ঐ খেলায় প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান হিসেবে ও বৈশ্বিকভাবে পঞ্চম ক্রিকেটার হিসেবে উভয় ইনিংসে সেঞ্চুরি করেন তিনি। প্রথম ইনিংসের ১১৪ রান আসে মূলতঃ দ্বি-শতকধারী রোচের সহায়তায়। দ্বিতীয় ইনিংসে রক্ষণাত্মক ইংরেজ বোলিং মোকাবেলা করে ১১২ রান তুললে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বড় ধরনের ব্যবধান গড়ে তুলে। এরপর অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অনুষ্ঠিত পরবর্তী সিরিজগুলোতেও সফলকাম হন। এ সময়ে হ্যাডলি ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রধান ব্যাটিং স্তম্ভ হিসেবে একচ্ছত্র প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকেন। ১৯৩৩ সালে ইংল্যান্ড সফর শেষে হ্যাজলিংডেনের পেশাদার ল্যাঙ্কাশায়ার লীগে খেলার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। ১৯৩৪-৩৫ মৌসুমে সফরকারী ইংরেজ দলের বিপক্ষে জ্যামাইকায় সিরিজের চতুর্থ ও চূড়ান্ত টেস্ট জয়ের মাধ্যমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল সিরিজ জয় করে। স্থানীয় বীর জর্জ হ্যাডলির অপরাজিত ২৭০* রানের বীরোচিত ইনিংসের সাথে মার্টিনডেল ও কনস্ট্যান্টাইনের ১৩ উইকেট লাভই এর প্রধান কারণ। এ টেস্টে বোলারদের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল।[৮] ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটলে খেলায় বিঘ্ন ঘটে তার। যুদ্ধ শেষে তিনি পুনরায় ১৯৪৮ সালে খেলতে নামেন। কিন্তু আঘাতজনিত কারণে তিনি তার পূর্বেকার সাফল্যকে ছাড়াতে পারেননি। তা সত্ত্বেও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক হিসেবে মনোনীত করা হয়। এরফলে তিনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে এ পদের জন্য অন্তর্ভুক্ত হন। কিন্তু, আঘাত ও রাজনীতির ফলে তিনি কেবলমাত্র একটি টেস্টেই অধিনায়ক ছিলেন। খেলার ধরন
হ্যাডলি’র সমগ্র খেলোয়াড়ী জীবনের অধিকাংশ সময়ই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল বিশ্বের অন্যতম দূর্বল দল হিসেবে পরিগণিত ছিল। কিন্তু দলে একজন বিশ্বমানের খেলোয়াড় হিসেবে থাকায় তাকে ভীষণ দায়িত্ব সচেতন হতে হয় ও তার ব্যাটিংয়ের উপরই দল যথেষ্ট নির্ভরশীল ছিল। টেস্টে ৩ নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে ২,১৯০ রান সংগ্রহ করেন যার গড় ছিল ৬০.৮৩। এছাড়াও, প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ৯,৯২১ রান করেন ৬৯.৮৬ গড়ে। মূল্যায়নউইজডেন কর্তৃপক্ষ তাদের ১৯৩৪ সালের সংস্করণে ম্যানি মার্টিনডেল ও ব্যাটসম্যান জর্জ হ্যাডলিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অপরিহার্য ও দৈত্যরূপে আখ্যায়িত করেছিল।[৯] ব্যাট হাতে জর্জ হ্যাডলির পাশাপাশি দলের সফলতা প্রাপ্তিতে মার্টিনডেলের উপর নির্ভর করতে হতো।[১০] তাসত্ত্বেও, জর্জ হ্যাডলিকে উইজডেন কর্তৃপক্ষ অন্যতম বর্ষসেরা ক্রিকেটারের সম্মাননায় অভিষিক্ত করে; ম্যানি মার্টিনডেলকে নয়। ব্রিজিত লরেন্স মন্তব্য করেন, মার্টিনডেল দ্রুততার সাথে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম সেরা টেস্ট ফাস্ট বোলারের মর্যাদা পেয়েছেন। তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট মর্যাদা প্রাপ্তির শুরুর দিকের পেস আক্রমণ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ও জর্জ হ্যাডলির ন্যায় ব্যাটসম্যানেরা দলের ভিত গড়ে তুলেছেন।[১১] অবসর১৯৪৯ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত টেস্ট খেলায় অংশগ্রহণ না করলেও তিনি ইংরেজ লীগ ক্রিকেটে খেলেন। প্রথমে খেলেন ল্যাঙ্কাশায়ার ও পরবর্তীকালে বার্মিংহাম লীগে। ১৯৫৪ সালে জ্যামাইকায় ফিরে আসলে তার খেলোয়াড়ী জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে ও ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসায় তাকে গণসম্বর্ধনা দেয়া হয়। খেলোয়াড়ী জীবন থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি জ্যামাইকা সরকার কর্তৃক ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ক্রিকেট কোচের দায়িত্ব পালন করেন। ব্যক্তিগত জীবনবিখ্যাত ক্রিকেটার রন হ্যাডলি সম্পর্কে তার সন্তান ও নাতি ডিন হ্যাডলি টেস্ট ক্রিকেটার ছিলেন। তারা যথাক্রমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ইংল্যান্ড দলের পক্ষে ২ টেস্ট ও ১টি ওডিআই এবং ১৫ টেস্ট ও ১৩টি ওডিআইয়ে খেলেছেন। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এটিই প্রথম ঘটনা যেখানে ধারাবাহিকভাবে একই পরিবারের তিনটি প্রজন্ম অংশ নিয়েছে। তথ্যসূত্র
আরও দেখুন
গ্রন্থপঞ্জি
আরও পড়ুন
বহিঃসংযোগউইকিমিডিয়া কমন্সে জর্জ হ্যাডলি সংক্রান্ত মিডিয়া রয়েছে।
|